প্রার্থনা কবিতা প্রশ্নের উত্তর দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা।
![]() |
প্রার্থনা
দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা
কিছু বড় প্রশ্ন এবং ছোট প্রশ্নের উত্তর
উৎস
‘প্রার্থনা' কবিতাটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে। 'নৈবেদ্য' কাব্যে ১০০টি কবিতা রয়েছে, তার ৭২ নং কবিতা হল ‘প্রার্থনা' কবিতাটি। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, 'নৈবেদ্য' কাব্যের কোন কবিতারই নামকরণ করেননি কবি, নৈবেদ্য'-র ৭২ নং কবিতাটির প্রথম চরণ হল – চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির'। এই কবিতাটিই এখানে ‘প্রার্থনা’
শিরোনামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। নৈবেদ্য কাবাটির প্রথম প্রকাশ ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে। রবীন্দ্রনাথ এই কাব্যটি উৎসর্গ করেছেন পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
হারুন সালামের মাসি গল্পের প্রশ্নের উত্তর দেখুন।
কেন এলো না গল্পের প্রশ্নের উত্তর দেখুন
প্রার্থনা কবিতার ভাববস্তু:-
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নৈবেদ্য' কাব্যের কবিতাগুলি লিখতে শুরু করেন ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে আর শেষ করেন ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে। রবীন্দ্র কাব্য বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারব ‘চৈতালি’ থেকে ‘ক্ষণিকা' পর্যন্ত কবির মানসলোকে যে সর্বোচ্চ আদর্শের গভীর আকুতি লক্ষ করা যায়, তারই অন্তিম পর্যায় “নৈবেদ্য” কাব্যপর্ব। প্রাচীন ভারতের সরল, শান্তিময় জীবনধারার মধ্যেই যে কবি জীবনের সর্বোত্তম আদর্শকে খুঁজে পেতে চেয়েছেন, তারই সাক্ষ্য বহন করছে নৈবেদ্য" কাব্যের অন্যান্য কবিতার মতোই ৭২ নং কবিতা "প্রার্থনা'"। কবির অন্তরাত্মার অনুভবের ফসল আলোচ্য কবিতাটি।
ভারতের প্রাচীন সহজসরল সত্তাকে কবি বর্তমানে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না। সর্বগ্রাসী অধঃপতন যেন ভারতকে গ্রাস করেছে। কবি অনুভব করেন ভারতীয়দের মর্মলোক আজ আচ্ছন্ন হয়েছে গ্লানিতে। অল্পেই তাদের শির হচ্ছে অবনত আর জ্ঞান এখানে বন্ধ হয়ে পড়ছে সংকীর্ণতার জটাজালে। কবি চান ভারতীয়রা চিত্তকে ভয়শূন্য করে, উন্নত শিরে, মুক্ত জ্ঞানের অধিকারী হোক।
গৃহের সীমাবদ্ধ গন্ডিকে অতিক্রম করে মুক্ত পৃথিবীতে এগিয়ে যেতে হবে দেশবাসীকে, নানা কাজের মধ্যে কর্মমুখর থেকে নিজেকে করতে হবে সার্থক।
সংকীর্ণ আচারের মলিনতাকে দূর করতে হবে আর ভারতীয়দের জাগ্রত হতে হবে আপন পৌরুষত্বে। ঈশ্বরবিশ্বাসী কবির মতে সকল কর্ম-চিন্তা-আনন্দের নেতা হলেন পরমেশ্বর। তিনিই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে ভারতীয়দের প্রাচীন গৌরবে প্রতিষ্ঠিত করবেন। অর্থাৎ নানা আঘাতের মধ্য দিয়েই ভারতীয়দের মানসিক অচলাবস্থা দূরীভূত হবে এবং তারা পূর্ব গৌরবময় পরিবেশ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবেন।
প্রার্থনা কবিতার বিষয়বস্তু:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থের একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা 'প্রার্থনা'। ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীন ভারতের সহজসরল অথচঅকুতোভয়, আনতশির মানসিকতাকে মন-প্রাণ দিয়ে শ্রদ্ধা করেছেন। কবির বর্তমান ভারতবর্ষ যেন সংকীর্ণ চেতনা, ভ্রান্ত বিশ্বাস, আচারসর্বস্ব ও যুক্তিহীনতার স্বীকার হয়ে পড়েছে। কবি সেই ভারতবর্ষকে আকাঙ্ক্ষা করেছেন যেখানে ভয়শূন্য চিত্তে, উন্নতশির দেশবাসী কর্মসাধন করবে; যেখানে জ্ঞানচর্চার প্রেক্ষিত হবে বাধাবন্ধনহীন; মুক্তচিন্তার বিস্তার ঘটবে সেখানে। সেই ভারতের অধিবাসীদের কাছে সুযোগ থাকবে স্বাধীনভাবে এগিয়ে যাওয়ার, গণ্ডিবদ্ধ জীবনচেতনার জটাজাল থেকে তারা বেরিয়ে আসার সাহস দেখাবে। ভারতীয়রা হবেন প্রকৃতই কর্মবীর। অর্থাৎ বিবিধ কর্মের মাধ্যমে তারা
নিজেদেরকে বিকশিত করার সুযোগ পাবে এবং ‘দেশে দেশে দিশে দিশে তাদের কর্মধারা প্রসারিত হবে। বর্তমানে দেশবাসী যেন বিচার বিবেচনাহীন ও বিবেকবোধহীন ভারতীয়তে পরিণত হয়েছে। আপন কর্মসাধনা ও জ্ঞানচর্চার বিকাশের মাধ্যমে ভারতীয়রা নিজেদেরকে সার্থক করে তুলবে; তুচ্ছ আচারের সংকীর্ণতা তাদের মনন তথা বিবেকের সুকুমার প্রবৃত্তিকে গ্রাস করবে না; প্রাচীন ভারতের সৌর্য-বীর্য তথা বীরত্বের সাধনায় বর্তমান ভারতীয়রা হয়ে উঠবেন পৌরুষদীপ্ত—এমন ভারতের আকাঙ্ক্ষা করছেন কবি।
কবির মতে পরমপুরুষ তথা পরমেশ্বর সর্বশক্তিমান। তাই তাঁর কাছে কবির বিনম্র প্রার্থনা—তিনি যেন কল্পচেতনায় আঘাত হেনে ভারতীয়দের চিন্তার জড়তা থেকে, জ্ঞানচর্চার সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করেন। কারণ পরম পিতা স্বয়ং সকল কর্ম-চিন্তা-আনন্দের হোতা। তাই তিনিই মানসিক দুর্বলতা, ভীরুতার সাধনা, সংকীর্ণতা থেকে ভারত তথা ভারতবাসীকে মুক্ত করে ভারতকে স্বর্গসুখ প্রদানকারী দেশে পরিণত করবেন।
প্রার্থনা কবিতা নামকরণের সার্থকতা :
যে কোন বিষয় বস্তুর নামকরণে একটা যথেষ্ট তাৎপর্য আছে । নামকরণের মাধ্যমেই রচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগাম ধারণা করা যায়। সাহিত্যের একটি প্রধান অঙ্গ হল নামকরণ।
নামকরণ বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন- বিষয়কেন্দ্রিক, চরিত্র প্রধান, ব্যঞ্জনধর্মী ইত্যাদি।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থের ৭২ নং কবিতা, যার প্রথম চরণ—'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’; এই কবিতাটিই আমাদের পাঠ্যাংশের 'প্রার্থনা' কবিতা। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, 'নৈবেদ্য' কাব্যের কোনো
কবিতারই নামকরণ করেননি কবি। হয়তো শিক্ষার্থীদের সুবিধার কথা চিন্তা করেই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ আলোচ্যমান কবিতাটির একটি গ্রহণযোগ্য নামকরণ করেছেন 'প্রার্থনা'।
'প্রার্থনা' শব্দের মাধ্যমে কারও কাছে বিনম্র চিত্তে কিছু চাওয়া বা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা। এখানে ভগবানের কাছে কিছু চাওয়াকে
বোঝানো হয়েছে। 'নৈবেদ্য' কাব্যের অন্যান্য অনেক কবিতার মতোই্ ৭২ নং কবিতাটিতেও ভগবানের কাছে ভারতবাসীর আত্মিক শক্তিলাভের প্রার্থনা করেছেন কবিগুরু। প্রাচীন ভারতের আদর্শে শ্রদ্ধাশীল কবি উপলব্ধি করেছেন বর্তমান ভারতীয়দের আত্মিক অবনতি ঘটেছে অনেকখানি। নানা দুর্বলতায় আচ্ছন্ন আজকের ভারতীয় মনন। দেশবাসীর দুর্দশা উপলব্ধি করে তাদের হৃদয়ে প্রকৃত জীবনসত্যকে উন্মোচিত করার প্রার্থনা করেছেন কবি পরমেশ্বরের কাছে। কবিতাটি হয়ে উঠেছে ভগবানের কাছে ভক্তিবিনম্র কবিচিত্তের আন্তরিক প্রার্থনা'।
পরমেশ্বরের কাছে কবি সেই ভারতের প্রার্থনা করেছেন—যেখানে ভারতীয়রা হবেন মানসিকতায় ভয়শূন্য, উন্নত শির। তাঁরা হবেন মুক্ত জ্ঞানের অধিকারী; গৃহের ক্ষুদ্র গণ্ডিতে আবদ্ধ থাকবে না তাদের জ্ঞানচর্চা। ভারতীয়রা ছড়িয়ে পড়বে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জ্ঞানার্জনের আকাঙ্ক্ষার ক্ষুদ্র আচারের গণ্ডি থাকবে না তাদের মধ্যে। মানবমনের হৃদয়ের উৎসমুখ থেকে উৎসারিত হবে নির্দ্বিধায়। সেই ভারতের অধিবাসীগণ সর্বক্ষণ লিপ্ত থাকবেন কর্মের সাধনায়। তাদের চলার পথে কোনো বাধাই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। সংকীর্ণ চেতনার বেড়াজাল ভারতীয়দের বিচারবোধকে আচ্ছন্ন করতে পারবে না। অখণ্ড পৌরুষত্ব বজায় থাকবে তাদের–এমন ভারতের আকাঙ্ক্ষা করেছেন কবিগুরু। কবিগুরু অনুভব করেন পরমেশ্বরই সকল কর্ম, চিন্তা ও আনন্দের হোতা। তাই তাঁর কাছেই কবি প্রার্থনা করেছেন পূর্বোক্ত আকাঙ্ক্ষাগুলির সফল রূপায়ণের। পরমেশ্বর যেন কঠিন আঘাতের মাধ্যমে ভারতীয়দের চৈতন্যের জগৎকে জাগ্রত করে তোলেন, যাতে ভারতীয়রা পুনরায় প্রাচীন গৌরব ফিরে পায়, ভারতবর্ষ যেন আবার নতুন প্রাণবন্যায় ভাসতে পারে-এমন প্রার্থনাই কবিগুরু পরমেশ্বরের কাছে করেছেন। এভাবেই আলোচ্যমান কবিতায় পরমেশ্বরের প্রতি কবিহৃদয়ের বিনম্র প্রার্থনা প্রকাশিত হয়েছে। তাই সামগ্রিক আলোচনার প্রেক্ষাপটে কবিতাটির নামকরণ ‘প্রার্থনা’ ব্যঞ্জনাময় ও সার্থক হয়েছে বলে আমার মনে হয় ।
সংক্ষিপ্ত উত্তর
প্রশ্ন: ‘প্রার্থনা' কবিতাটির উৎসসহ কবিতাটির রচনাকালের পরিচয় দাও।
উত্তর :‘প্রার্থনা' কবিতাটির উৎস হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থ। উক্ত কাব্যের ৭২ নং কবিতার প্রথম চরণ 'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির।' এই ৭২ নং কবিতাই 'প্রার্থনা' শীর্ষনামে পাঠ্যাংশে সংকলিত হয়েছে।
‘প্রার্থনা' কবিতাসহ ‘নৈবেদ্য' কাব্যের সকল কবিতাই ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে রচিত হয়েছে।
প্রশ্ন: 'নৈবেদ্য' কাব্যটি কবে প্রকাশিত হয় এবং কাব্যটি কাকে উৎসর্গ করা হয়েছিল?
উত্তর : ‘নৈবেদ্য” কাব্যগ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছে ১৩০৮ বঙ্গাব্দের আষাঢ় মাসে (১৯০১ খ্রিস্টাব্দে)। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'নৈবেদ্য' কাব্যটি উৎসর্গ করেছিলেন তাঁর পিতৃদেব মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে।
প্রশ্ন: “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য,”—এখানে ‘যেথা' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন ?
উত্তর : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘প্রার্থনা' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। নৈবেদ্য' কাব্যের ৭২ নং কবিতা ‘প্রার্থনা'-তে কবি এমন
এক ভারতবর্ষের আকাঙ্ক্ষা করেছেন, যেখানে ‘চিত্ত' অর্থাৎ মন থাকবে সকলপ্রকার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। ক্ষুদ্রতা বা মানসিক অচলায়তনের গভীর বেড়াজালে আবদ্ধ থাকবে না মানবের হৃদয়-মন। ভয়হীনভাবে এবং দীপ্ত ভঙ্গিতে প্রত্যেকে আপন কর্মসাধনায় মগ্ন থাকবেন। ‘যেথা' বলতে কবি এমন ভারতবর্ষের কথাই বুঝিয়েছেন।
প্রশ্ন: “উচ্চ যেথা শির”–শির উচ্চ থাকার অর্থ লেখো।
উত্তর : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘নৈবেদ্য’কাব্যগ্রন্থের ৭২ নং কবিতা 'প্রার্থনা থেকে নেওয়া হয়েছে। কবি প্রাচীন ভারতবর্ষের গর্বের সন্ধান দিয়েছেন উদ্ধৃতিটির মাধ্যমে; যেখানে ভারতীয়রা ভয়ে অবনতমস্তক
হতেন না, উন্নত শিরে মেরুদণ্ড সোজা রেখে সকলপ্রকার বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহস দেখাতে পারতেন। কাপুরুষতা বা ভীরুতায় পর্যবসিত না-হয়ে উন্নত মস্তকে অবস্থান করাকে কবি ‘উচ্চ শির’ বলে বুঝিয়েছেন।
প্রশ্ন: “জ্ঞান যেথা মুক্ত”—মুক্তজ্ঞান বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘নৈবেদ্য' কাব্যের ৭২ নং কবিতা ‘প্রার্থনা' থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে কবি মুক্তজ্ঞানের আলোচনা করেছেন। কবির মতে জ্ঞান কেবলমাত্র পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না।
পাঠ্যপুস্তক থেকে অর্জিত জ্ঞান হল গণ্ডিবদ্ধ জ্ঞান। যে জ্ঞান প্রকৃতির পারিপার্শ্ব থেকে অর্জন করা হয়, সেই জ্ঞানের মধ্যে সংকীর্ণতার স্থান থাকে না। ক্ষুদ্রতা, মলিনতার দ্বারা যে জ্ঞানকে আবদ্ধ করা যায় না, সেই জ্ঞানই হল মুক্তজ্ঞান।
প্রশ্ন: “যেথা গৃহের প্রাচীর....” – কোন্ প্রসঙ্গে কবি ‘গৃহের প্রাচীর'-এর অবতারণা করেছেন?
উত্তর : প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চার প্রসার, তৎকালীন ভারতীয়দের সাহসিকতা এবং মুক্তচিন্তার বিচ্ছুরণ কবিকে মুগ্ধ করেছে অথচ বর্তমান ভারতবর্ষে তা অনুপস্থিত বলে উপলব্ধি করছেন কবি। কবির ধারণা বর্তমান ভারতীয়রা গৃহের ক্ষুদ্র পরিসরেই নিজেদের আবদ্ধ করে রেখেছে। জ্ঞানচর্চা এখানে অবরুদ্ধ, নানাপ্রকার সংকীর্ণ আচার-বিচারের বেড়াজালেই মগ্ন হয়ে পড়েছেন বর্তমান ভারতবাসী, যা প্রকৃত জ্ঞানচর্চার পরিপন্থী। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘প্রার্থনা' কবিতায় 'গৃহের প্রাচীর'-এর অবতারণা করেছেন।
প্রশ্ন: 'দিবসশর্বরী' শব্দের অর্থ লিখে 'প্রার্থনা' কবিতায় উক্ত শব্দ প্রয়োগের প্রসঙ্গ লেখো।
উত্তর : "দিবসশরী' শব্দের অর্থ হল 'দিন-রাত', তবে 'প্রার্থনা' কবিতায় সর্বক্ষণকে দ্যোতিত করা হয়েছে উক্ত শব্দের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রাচীন ভারতের মুক্তজ্ঞানচর্চার অনুরাগী। তিনি লক্ষ করেছেন বর্তমান ভারতবাসী জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে কারণ জ্ঞানচর্চার
ক্ষেত্র এখানে সংকীর্ণতায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। জ্ঞানচর্চাকে দিন-রাত অর্থাৎ সর্বক্ষণ আপন প্রাজ্ঞাণকে ছাড়িয়ে বিশ্বমাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এই প্রসঙ্গেই কবি প্রার্থনা' কবিতায় দিবসশর্বরী' শব্দটি প্রয়োগ করেছেন।
প্রশ্ন: “বসুধারে রাখে নাই ক্ষুদ্র খণ্ড করি”-কে 'বসুধারে' ক্ষুদ্র খণ্ড করে রাখেনি?
উত্তর : প্রশ্নোকৃত অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘প্রার্থনা' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে 'রাখে নাই’--এই ইঙ্গিতটি প্রাচীন ভারতবর্ষের প্রতি করা হয়েছে। কবি উপলব্ধি করেছেন প্রাচীন ভারতবর্ষে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র সংকীর্ণ চেতনার তুচ্ছ আচারের বালুকারাশি দ্বারা আবদ্ধ ছিল না। তৎকালীন বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রগুলি উদার। সমগ্র পৃথিবীকে কখনও আপন গৃহের প্রাচীরের মাধ্যমে গণ্ডিবদ্ধ করে রাখা হয়নি সেসময়। দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষের জ্ঞানচর্চার বার্তা। এখানে সেই প্রাচীন ভারতের কথাই বলা হয়েছে, যে বসুধারে ক্ষুদ্র খণ্ড করে রাখেনি।
প্রশ্ন: প্রার্থনা কবিতা হৃদয়ের য উৎসমুখ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : মানুষের প্রাণের আবেগ প্রকাশের উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হল কথা বা মুখনিঃসৃত শব্দ, আর এই আবেগের উৎসস্থল তো মানবহৃদয়ই। আপন আপন বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি হল মানবহৃদয়। এই হৃদয়ই পারে সকল প্রকার বাধাবিঘ্নকে অতিক্রম করে প্রাণের কথা বা মনের কথাকে উন্নতশিরে সাহসিকতার সঙ্গে প্রকাশ করতে। হৃদয়ের অন্তঃস্থল বা হৃদয়ের উৎসমুখ' বলতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাই মানবতাকেই বুঝিয়েছেন।
প্রশ্ন: “যেথা নির্বারিত স্রোতে.... ” 'নির্বারিত স্রোত' কথার অর্থ লেখো।
উত্তর : ‘বারিত' বলতে বোঝানো হয় নিষিদ্ধ বা আবদ্ধতাকে। অর্থাৎ ‘নির্বারিত' কথার অর্থ হল যা নিষিদ্ধ নয় বা আবদ্ধ নয়- এমন পরিস্থিতি।
নির্বারিত স্রোত কোনো বাধাবিঘ্নকে মেনে চলে না। কোনো শক্তিই এই স্রোতকে আটকে রাখতে পারে না। কবির আশঙ্কা প্রাচীন ভারতবাসীদের মতো বর্তমান ভারতীয়রাও সকল বাধাবন্ধন, সংকীর্ণতাকে অতিক্রম করেই দুর্নিবার গতিতে তাদের কর্মসাধনার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে বিশ্বের নানা প্রান্তে। 'প্রার্থনা' কবিতায় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাধাহীনভাবে এগিয়ে চলার
গতিকেই 'নির্বারিত স্রোতা বলে বুঝিয়েছেন।
প্রশ্ন: 'প্রার্থনা' কবিতায় ভারতীয়দের বৈশিষ্ট্য কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে?
উত্তর : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'প্রার্থনা' কবিতায় প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চা, চিন্তাচেতনা, সাহসিকতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছেন। প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র ছিল মুক্ত বা বন্ধনহীন, অর্থাৎ সেখানে স্বাধীনভাবে ভারতীয়রা
জ্ঞানচর্চার সুযোগ পেতেন। মানুষ উন্নত মস্তকে সাহসিকতার সঙ্গে নিজের স্বাধীন চিন্তার প্রকাশ ঘটাতে পারতেন। বাক্য সেখানে মানবহৃদয়ের উৎসমুখ থেকে উৎসারিত হত, ভারতীয়দের কর্মধারা ‘দেশে দেশে দিশে দিশে ছড়িয়ে যেত। তুচ্ছ আচারের বালুকারাশি প্রাচীন ভারতীয়দের বিচারবোধকে অবরুদ্ধ
করে রাখেনি।
প্রশ্ন: ‘প্রার্থনা কবিতায় কবি 'তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি' বলতে কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'নৈবেদ্য' কাব্যের ৭২ নং কবিতা 'প্রার্থনা'- প্রশ্নোদ্ভূত শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন। 'আচার' অর্থাৎ নানাপ্রকার রীতিনীতি।
ভারতীয়রা যুগ যুগ ধরেই নানা ধরনের ‘আচার মেনে আসছে, যার অধিকাংশই অবৈজ্ঞানিক চিন্তার ফসল, যা সমাজের অগ্রগতির পরিপন্থী। বালুকারাশিও তেমনই চলার পথকে মসৃণ না-করে কঠিন করে তোলে, অগ্রগমনের পথে
প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করে। তাই আচার-বিচারের সংকীর্ণতাকে বোঝাতেই কবি প্রশ্নোদ্ভূত শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন।
প্রশ্ন: “বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি”—উদ্ধৃতাংশে কবি কীসের ইঙ্গিত দিয়েছেন?
উত্তর : অজস্র সংস্কারের নাগপাশে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে বর্তমানে ভারতীয়রা নিজেদের চলার পথকেই অপ্রশস্ত করে ফেলেছে। ফলে যুক্তি দিয়ে বিচার করার ইচ্ছা বা প্রবণতা থেকে তারা সরে যাচ্ছে। এই মানসিক অসারতাকে দূর করতে হবে। সব কিছুকে বিচারবিশ্লেষণ করতে হবে মুক্তির আলোকে। তুচ্ছ সংস্কারের আবিলতা যাতে জীবনকে গ্রাস করতে না পারে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে ভারতবাসীকে। এভাবেই ভারতীয়রা তাদের প্রাচীন গৌরবকে ফিরে পেতে পারবে। এমন ইঙ্গিতই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
"প্রার্থনা' কবিতার উদ্ধৃত অংশে করেছেন।
প্রশ্ন: "পৌরুষেরে করেনি শতধা...”—উক্তিটির অর্থ বিবৃত করো।
উত্তর : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'প্রার্থনা' কবিতায় প্রশ্নোদ্ধৃত উদ্ধৃতিটি প্রয়োগ করেছেন। আলোচ্যমান কবিতায় কবি প্রাচীন ভারতের প্রশংসা করেছেন কুণ্ঠাহীনভাবে। কবির মতে প্রাচীন ভারতের চিত্ত ছিল ভয়শূন্য; উচ্চশিরে সাহসিকতাকে আশ্রয় করে তারা বিপদের বিরোধিতা করত। তাদের বীর্যবত্তা তথা পৌরুষ ছিল অটল, কোনো ভয় বা প্রলোভনেই পৌরুষকে তারা বিকিয়ে দিত না। তাদের নানাবিধ কর্মধারায় এই পৌরুষের প্রতিফলন ঘটতে দেখা
যেত। ভীরুতার সাধনায় তারা মগ্ন থাকত না। লৌহসম কঠিন, বীরোদাত্ত তাদের পৌরুষ ছিল অভঙ্গুর।
প্রশ্ন: “তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা, কবি কাকে উদ্দেশ্য করে কেন এরূপ উক্তি করেছেন?
উত্তর : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'প্রার্থনা' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে পরমেশ্বরের প্রতি কবি প্রশ্নের উক্তিটি করেছেন।
কবির প্রার্থনা পরমেশ্বর যেন ভারতীয়দের বন্ধচেতনায় আঘাত হেনে চিন্তার জড়তা থেকে, জ্ঞানচর্চার সীমাবদ্ধতা থেকে ভারতীয়দের মুক্ত করেন।
কারণ পরম-পিতাই হলেন সকল প্রকার কর্ম-চিন্তা-আনন্দের নেতা। তিনিই পারবেন ভারতীয়দের সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত করে ভারতবর্ষকে স্বর্গসুখ প্রদানকারী রাজ্যে পরিণত করতে। তাই কবি পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রশ্নোদ্ভূত কথাগুলি বলেছেন।
প্রশ্ন: “ভারতেরে সেই স্বর্গে কর জাগরিত”– উদ্ধৃতাংশের অর্থ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : জ্ঞানসাধনা ও কর্মসাধনায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করত প্রাচীন ভারতবর্ষ। জ্ঞানচর্চার বিকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে বিশ্বের অন্যান্য দেশ ভারতবর্ষকে কুর্নিশ জানাত ভারতীয় জ্ঞানসাধনার উচ্চমার্গের কারণে। তবে বর্তমান ভারতবাসী
আর সেই গর্বের স্থানে নেই। জ্ঞানচর্চায় জড়তা ও গণ্ডিবদ্ধতা তাদের গ্রাস করেছে। তাই পরমেশ্বরের কাছে কবির প্রার্থনা, তিনি যেন আঘাতের মধ্য
দিয়ে ভারতবর্ষকে পূর্ব গৌরবে অধিষ্ঠিত করেন। অর্থাৎ জ্ঞানসাধনার সমুন্নত শিখরে ভারতীয়দের প্রতিষ্ঠিত করেন।
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন: "প্রার্থনা কবিতার উৎস লিখে এই কবিতায় কবির কোন মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে আলোচনা করো।
উত্তর : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থ থেকে 'প্রার্থনা' কবিতাটি গ্রহণ করা হয়েছে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, 'নৈবেদ্য' কাব্যের ৭২ নং কবিতা হল 'প্রার্থনা"।
প্রাচীন ভারতের শিক্ষাচিন্তার আদর্শে আস্থাশীল ছিলেন কবিগুরু। তারই প্রতিফলন ঘটেছে 'প্রার্থনা' কবিতায়। কবির মতে বর্তমান ভারতবাসী আবদ্ধ হয়ে পড়েছে সংকীর্ণ চেতনা, ভ্রান্ত বিশ্বাস ও আচার সর্বস্বতায়। ফলে তারা অবনতশির আর গণ্ডিবদ্ধ জ্ঞানচর্চায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। অলস মনোভাব আর কর্মবিমুখতা তাদের গ্রাস করেছে। বিবেকবোধহীন, বিচারবিবেচনাহীন হচ্ছে তারা। তাই সর্বকর্ম নিয়ামক ঈশ্বরের কাছে কবির প্রার্থনা—ঈশ্বর যেন মানসিক দুর্বলতা, ভীরুতা, সংকীর্ণতা থেকে ভারতবাসীকে মুক্ত করেন। কবির এমন প্রার্থনা থেকে ভারতবাসীর প্রতি কবির আত্মিকতা, মর্মবেদনা এবং একই সঙ্গে তাঁর ঈশ্বরবিশ্বাসী মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে।
প্রশ্ন: 'প্রার্থনা' কবিতায় ভারতীয়দের কর্মধারার বৈশিষ্ট্য কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে?
উত্তর : ভারতীয়দের জ্ঞানচেতনা ও কর্মধারার কিছু বৈশিষ্ট্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “নৈবেদ্য' কাব্যের ৭২ নং কবিতা—'প্রার্থনা' কবিতায় কবির লেখনীতে ধরা পড়েছে। কবি লক্ষ করেছেন প্রাচীন ভারতে জ্ঞানচর্চা ক্ষুদ্রতার গণ্ডিতে আবদ্ধ ছিল না। সাহস ও বীর্যবত্তার পরিচয় তুলে ধরত প্রাচীন ভারতবর্ষ। কোনো ভয় বা প্রলোভনের কাছেই বিকিয়ে যায়নি প্রাচীন ভারতীয়দের পৌরুষ। দেশে দেশে দিকে দিকে সহস্রবিধ উপায়ে ছুটে চলত তাদের কর্মস্রোতধারা—এমনই গতিশীল ও প্রাণময় ছিল প্রাচীন ভারতের মানুষজন। তবে কবির মতে বর্তমান ভারতবর্ষ সেই গর্বের স্থানে নেই। নানা সংকীর্ণ চিন্তা, আচার-বিচারের গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়েছে ভারতীয়দের জ্ঞান। অলসতা আর বিচার বোধহীনতা গ্রাস করছে তাদের চেতনাকে। যেন ভীরুতার সাধনায় লিপ্ত হচ্ছে তারা। এমনসব বৈশিষ্ট্যই কবি ভারতীয়দের মধ্যে লক্ষ
প্রশ্ন: “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির”– প্রসঙ্গসহ উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ৭২ নং কবিতা 'প্রার্থনা' থেকে নেওয়া হয়েছে। ঋষিকবি রবীন্দ্রনাথ প্রাচীন ভারতীয়দের বীরত্ব, সাহসিকতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। সেই প্রসঙ্গে।
আলোচনা করতে গিয়েই কবি উদ্ধৃতিটি ব্যবহার করেছেন। বর্তমান ভারতীয়দের চিত্তলোকে নানা প্রকারের দীনতা দেখা দিয়েছে। সংস্কারের আবর্তে নিজেদের বেঁধে ফেলেছে ভারতীয়রা। ফলে চিত্তের ভয়শূন্যতা, উন্নত শিরে সাহসিকতার পরিচয় অনেকটাই যেন ম্লান হয়ে গেছে। মানবসমাজে সর্বদাই ঘটে চলেছে প্রতিকূল শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম। অন্যায় প্রতি মুহূর্তে বিপর্যস্ত করে তুলছে জীবনকে। সেই প্রতিকূল পরিস্থিতি থেকে সসম্মানে বেরিয়ে আসার জন্যই প্রয়োজন উন্নত শির ও ভয়হীন চিত্ত। মানসিক দৃঢ়তা এক্ষেত্রে অবশ্যই প্রয়োজন, যা প্রাচীন ভারতবর্ষ দেখাতে সক্ষম হয়েছে বলে কবি মনে করেন। উদ্ধৃতাংশে কবির সেই ভারতের আকাঙ্ক্ষাই প্রতিফলিত হয়েছে।
প্রশ্ন: “জ্ঞান যেথা মুক্ত,”–উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য লেখো।
উত্তর : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘নৈবেদ্য’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত ৭২ নং কবিতা ‘প্রার্থনা’ থেকে প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে। আলোচ্য কবিতায় প্রাচীন ভারতবর্ষের জ্ঞানচর্চার প্রসঙ্গে কবি উক্তিটি করেছেন।
মানব জগৎ ও জীবনের সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন জ্ঞানচর্চার প্রসার ঘটানো। পাঠ্যপুস্তকের গণ্ডিবদ্ধতা থেকে বাইরে বের করে আনতে হবে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রকে। পাঠ্যপুস্তক থেকে যে জ্ঞান অর্জিত হয়, তাকে ব্যাবহারিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে, সেই জ্ঞানের জগৎকে সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। প্রকৃতি থেকে যে জ্ঞান অর্জন করা হয়, তা কোনো সংকীর্ণ গণ্ডিতে বন্ধ থাকে না, অর্থাৎ
সেখানে থাকে না ক্ষুদ্র চিন্তাচেতনার অবকাশ। বহির্বিশ্বের সঙ্গে ওতোপ্রতোভাবে মিশে জ্ঞানচর্চার পরিধিকে প্রসারিত করতে হবে। সংকীর্ণ চেতনা, মানসিক দীনতা, আচার সর্বস্বতার দ্বারা যে জ্ঞান কালিমালিপ্ত হয়নি, তাই হল মুক্ত জ্ঞান। কবি এমন ক্ষেত্রই আকাঙ্ক্ষা করেছেন, যেখানে এমন মুক্ত জ্ঞানের চর্চা হবে।
প্রশ্ন:“বসুধারে রাখে নাই ক্ষুদ্র খন্ড করি,” – প্রসঙ্গসহ উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'নৈবেদ্য' কাব্যের অন্তর্গত ৭২ নং কবিতা 'প্রার্থনা' থেকে প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি নেওয়া হয়েছে। প্রাচীন ভারতবর্ষের বাধাবন্ধনহীন মুক্ত জ্ঞানচর্চা প্রসঙ্গেই কবি উক্তিটি করেছেন।
প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চা ছিল কোনোপ্রকার সংকীর্ণতাহীন, ক্ষুদ্র আচারের বন্ধনহীন; তবে বর্তমান ভারতের অবস্থান ঠিক উলটো। ভারতবাসী বর্তমানে সংকীর্ণ চেতনা তথা অন্ধ সংস্কারের প্রাচীরে নিজেদেরকে আবদ্ধ করে রাখতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, যা প্রকৃত জ্ঞানচর্চার পরিপন্থী। বিশ্বের মাঝে নিজেদের প্রাণময়তাকে ছড়িয়ে দিতে বর্তমান দ্বিধাগ্রস্ত। অথচ প্রকৃত জ্ঞানী কখনোই নিজেকে আবদ্ধতার প্রাচীরে আবদ্ধ রাখতে পারেন না, তা উচিতও নয়। আপন গৃহকে নিয়ে যেতে হবে বহিপানে। বিশ্বের সকল স্থান থেকেই প্রয়োজনীয় জ্ঞান লব্ধ করতে হবে। দিনরাত সর্বক্ষণ সেই চেষ্টায় লিপ্ত থাকা প্রয়োজন। ক্ষুদ্র বা খণ্ড জ্ঞানের মাধ্যমে বসুধাকে কখনোই খণ্ড করে রাখাটা উচিত নয় বলেই কবি মনে করেছেন। প্রশ্নোদ্ধৃত অংশে কবি
এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন :- “যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎস মুখ হতে/উচ্ছ্বসিয়া উঠে,”
—উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'নৈবেদ্য' কাব্যের অন্তর্গত ৭২ নং কবিতা 'প্রার্থনা' থেকে নেওয়া হয়েছে। ভারতবাসীদের জ্ঞানচর্চা, সাহসিকতা ও হৃদয়বত্তার পরিচয় প্রসঙ্গে কবি উদ্ধৃত উক্তিটি করেছেন। মানুষের প্রাণের আবেগ প্রকাশের প্রধান মাধ্যম মুখনিঃসৃত শব্দ বা কথা।
এই কথা বা অনুভূতি তথা আবেগের উৎসস্থল হল মানববৃদয়। প্রত্যেকে বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি হল আপনার হৃদয়। হৃদয় থেকে উৎসারিত ভাষা তথা আবেগের প্রকাশ ঘটে শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মাধ্যমে। এই হৃদয়ই পারে সকলপ্রকার বাধাবিঘ্ন জড়তাকে অতিক্রম করে প্রাণের আবেগ, মনের কথাকে উন্নত মস্তকে, অকৃতভয়ে সকলের সামনে প্রকাশ করতে। এই মানবহৃদয়ই হল ভালো-মন্দ, চিন্তাচেতনার মূল উৎসস্থল। প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটির মাধ্যমে কবি এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন
প্রশ্ন: “দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়।” – “কর্মধারা' কথার অর্থ উল্লেখ করে উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর : প্রশ্নোকৃত অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'নৈবেদ্য' কাব্যের অন্তর্গত ৭২ নং কবিতা প্রার্থনা' থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে 'কর্মধারা' বোঝাতে অনবরত কর্মপ্রবাহকে বুঝিয়েছেন কবি। অর্থাৎ ‘কর্মধারা’ কথা অর্থ হল কর্ম-প্রবাহ।
ভারতবাসী কখনও কর্মহীনতা তথা অলসতাকে প্রশ্রয় দেয়নি। কর্মহীনতা তথা গতিহীনতা জীবনকে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়। সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবাসী এই নীতিকে শাহার সঙ্গে গ্রহণ করেছে এবং কর্মের লক্ষ্যেই ছুটে চলেছে তারা। শুধু আপনার জন্মস্থান বা বিশেষ কোনো দেশে নিজেকে আটকে না-রোখে বিশ্বের নানা প্রান্তে ভারতীয়রা পৌঁছে গেছে কর্মের পতাকা বহন করে। কর্ম ও কল্যাণসাধনের মাধ্যমেই তারা জীবনের সত্যকে অনুভব করেছে। তারা বুঝেছে যে, কর্মপ্রবাহ তথা কর্মধারাই সভ্যতার গতিকে অব্যহত রাখতে পারে।
প্রশ্ন: তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি কী করতে পারে আর কী করতে পারেনি— 'প্রার্থনা' কবিতা অবলম্বনে লেখো।
উত্তর : কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রার্থনা
'' কবিতায় তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি-র উত্থাপন করেছেন। এই মরুবালুরাশি বিচারের পথকে গ্রাস করে ফেলতে পারে।
"তুচ্ছ আচারের মধুবালুরাশি হল সংকীর্ণ আচারসর্বস্বতার নেতিবাচক দিক ।আচার-বিচারের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মানবমনের স্বাভাবিক বিচারবোধ বা বিবেকবোধ জাগ্রত হতে পারে না। ফালে মানুষ হারিয়ে ফেলে ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য খোঁজার ক্ষমতাকে। আর তখনই প্রকৃত বিচার সে করতে পারে না। যুগ যুগ ধরেই নানা সংকীর্ণ আচার মেনে আসছে ভারতীয়রা, যা সভ্যতার অগ্রগতির পরিপন্থী। কিন্তু কবি সেই ভারতের কথা বলেছেন- যেখানে
সংকীর্ণ সংস্কারের আবর্তে নিজেদের বিবেকবোধ ও বিচারবোধকে হারিয়ে ফেলেনি ভারতীয়রা। ফলে বিচারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারেনি।
"তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি, অর্থাৎ সংকীর্ণ চেতনা ভারতীয়দের ন্যায়বোধ বা বিচারবোধকে গ্রাস করতে পারেনি।
প্রশ্ন:- প্রার্থনা' কবিতায় কবি কাকে এবং কেন 'সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা' বলেছেন?
উত্তর : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 'প্রার্থনা' কবিতায় 'সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা' বলেছেন পরমেশ্বরকে।
পরমেশ্বরে বিশ্বাসী কবি মনে করেছেন এই জগৎ ও জীবনের স্রষ্টা হলেন ঈশ্বর। তিনিই সর্বশক্তিমান। জগতে এমন কোনো কার্য বা ঘটনা ঘটে না, যেখানে পরমেশ্বরের পবিত্র স্পর্শ পড়ে না। কবিগুরু অনুভব করেছেন বর্তমান ভারতীয়রা অলস, কর্মবিমুখ, চিন্তাশক্তিহীন একপ্রকার জড়তা দ্বারা আক্রান্ত। ফলে ভারতীয়রা হারিয়েছে তাদের পূর্বগৌরব। এই অবস্থা থেকে ভারতীয়দের উত্তরণ ঘটাতে পারে কেবলই সর্বশক্তিমান পরম-পিতা। তিনিই পারবেন বর্তমান ভারতীয়দের চিন্তাচেতনার জগতে আঘাত হেনে তাদের কর্মস্রোতে ফিরিয়ে আনতে। পরমেশ্বরই পারবেন জ্ঞানচর্চার সীমাবদ্ধতার অবসান ঘটিয়ে ভারতীয়দের প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান দিতে। যেহেতু ঈশ্বরের অবস্থান সর্বময় এবং মানবজীবনের সকল কিছুরই স্রষ্টা তিনি। তাই আলোচ্য কবিতায় কবি পরমেশ্বরকে উদ্দেশ্য করে 'সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা বলেছেন।
প্রশ্ন:;"নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,”–কবির এমন আপনার তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর : প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'নৈবেদ্য' কাব্যের অন্তর্গত 'প্রার্থনা' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চা, সাহসিকতা সম্পর্কে কথা প্রসঙ্গে কবি উক্তিটি করেছেন।
কবির মতে প্রাচীন ভারতের মানুষের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র ছিল মুক্ত, উদার। নানা প্রকার সংস্কার-আচারের আবিলতা সেই জীবনধারাকে গ্রাস করতে পারেনি। কিন্তু বর্তমানে শুষ্ক আচার-অনুশাসনের জালে বন্দি ভারতীয়দের জীবন। মুক্ত জ্ঞানচর্চার অবকাশ নেই এখানে। বর্তমান ভারতীয়রা যেন আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে মোহনিদ্রায়। ভারতীয়দের এমন জড়তাগ্রস্ততা, মোহাচ্ছন্নতা দূর করতে পারেন কেবল পরমেশ্বর। তাই পরমেশ্বরের কাছে কবি প্রার্থনা করেছেন—তিনি যেন কঠোর আঘাতের মাধ্যমে ভারতীয়দের
তন্দ্রাচ্ছন্নতার অবসান ঘটিয়ে, তাদের যেন প্রাচীন গৌরবে উন্নীত করেন; অর্থাৎ ভারতীয়দের জাগতিক উন্নতির লক্ষ্যেই পরমেশ্বরের কাছে কবির প্রশ্নোদ্ধৃত প্রার্থনা।
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন ‘প্রার্থনা' কবিতায় কবি কীভাবে ভারতবর্ষকে স্বর্গে জাগরিত করার কথা বলেছেন, তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।
উত্তর: কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'নৈবেদ্য' কাব্যগ্রন্থের ৭২ নং কবিতা হল ‘প্রার্থনা'। আলোচ্যমান কবিতায় কবি প্রাচীন ভারতের বীরত্ব, উন্নত মানসিকতা, জ্ঞানচর্চার কুণ্ঠাবিহীন প্রশংসা করেছেন শুধু নয়, বর্তমান ভারতবর্ষকে পূর্বগৌরবে উন্নীত করার প্রার্থনাও করেছেন পরমেশ্বরের কাছে।
ভারতীয় সংস্কৃতির মূলসুর হল ঐক্য। ঐক্যের শক্তিতেই ভারতীয়দের মন থেকে বিদূরিত হয়েছিল আপন স্বার্থবোধ ও বিদ্বেশের চেতনা। তবে বর্তমানে সেই অখণ্ড ভারতের চিন্তার ক্ষেত্র থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে ভারতীয়রা—এটা কবির ধারণা। তাই বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা করেছেন কবিগুরু। ভারতের প্রাচীন গৌরব ছিল স্বর্গের মতোই শ্রেষ্ঠত্বের স্থানে। আলোচ্যমান 'প্রার্থনা' কবিতায় কবিগুরু যে স্বর্গের কথা বলেছেন, তা কোনো কাল্পনিক বা পারলৌকিক স্থান নয়, সেই স্বর্গ বিরাজমান এই মাটির পৃথিবীতেই; সেই স্বর্গ হল উদার মানসিকতা, উন্নত বুদ্ধি ও বিবেকবোধ সমন্বিত এই ধরাধাম। একদা ভারতবর্ষ তার জ্ঞানচেতনা, বিচারবোধ ও আধ্যাত্মিক কর্মসাধনার মাধ্যমে বিশ্বে শ্রেষ্ঠত্বের আসন লাভ
করেছিল। বর্তমান ভারত সেই ঔদার্যের স্থান থেকে অনেকটাই নীচে নেমে গেছে। কবির প্রার্থনা পরমেশ্বরের কাছে—তিনি ভারতীয়দের চেতনায় আঘ হেনে তাদের জাগিয়ে তোলেন, যেন তারা জ্ঞান-গরিমা, ন্যায়নীতিপূর্ণ বলিষ্ঠ জীবনাদর্শ পালনের মধ্য দিয়ে উন্নত শিরে উদার মানবিক চেতনায় উদ্বোধিত হবে। তাদের কর্মধারা দিকে দিকে প্রসারিত হবে, প্রাচীর যাবে ভেঙে, প্রতিষ্ঠিত হবে বলিষ্ঠ জীবনাদর্শ। এভাবেই ভারতবাসী আবার উদার মানসিকতা, উন্নত বুদ্ধি, বিবেকবোধ সমন্বিত স্বর্গে জাগরিত হবে বলে কবির বিশ্বাস।
প্রশ্ন: 'প্রার্থনা' কবিতায় কবি কী প্রার্থনা করেছেন? সেই প্রার্থনা কীভাবে পুরণ হতে পারে?
উত্তর : কবির প্রার্থনা : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'নৈবেদ্য' কাব্যের অন্তর্গত ৭২ নং কবিতা হল ‘প্রার্থনা’। আলোচ্যমান কবিতায় ঈশ্বরবিশ্বাসী কবিহৃদয় সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছেন—পরমেশ্বর যেন চেতনায় আঘাতের মাধ্যমে ভারতীয়দের চেতনার জড়ত্ব দূর করেন; জ্ঞানচর্চার সীমাবদ্ধতা, আচারসর্বস্বতা পরিহার করিয়ে ভারতীয়দের উন্নত জীবনাদর্শে
উন্নীত করে উচ্চ বিবেকবোধ সমন্বিত স্বর্গরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেন।
প্রার্থনা পূরণের উপায় : অখণ্ড ভারতীয়ত্বের চেতনা থেকে বর্তমান ভারতবর্ষ অনেকটাই দূরে সরে গেছে। ভারতের প্রাচীন গৌরব ছিল স্বর্গের
মতোই শ্রেষ্ঠত্বের স্থানে অধিষ্ঠিত। আলোচ্যমান কবিতায় বিবৃত স্বর্গ মানে প্রচলিত কোনো অলৌকিক স্বর্গ নয়, এই মাটির পৃথিবীতে মানুষের মাঝেই বিরাজিত সেই স্বর্গ। উদার আদর্শ, উন্নত মানসিকতা, মুক্ত চিন্তাচেতনার প্রসার ও গণ্ডিবিহীন জ্ঞানচর্চার অবকাশ আছে যেখানে—সেটাই হল আলোচ্যমান কবিতার স্বর্গ। একদা ভারতীয়দের বিবিধ কর্মধারা ছড়িয়ে পড়ত দিকে দিকে, সেটাই ছিল স্বর্গ। সেই স্বর্গে উন্নীত হতে হবে ভারতীয়দের। কবির প্রার্থনা পরমেশ্বরের কাছে—তিনি যেন ভারতীয়দের চেতনার জগতে আঘাত হেনে, তাদের জড়ত্বের অবসান ঘটান। তবেই ভারতীয়রা আবার তাদের হৃতগৌরব ফিরে পাবে। এভাবেই পরমেশ্বর কবির প্রার্থনা পূরণ করতে পারেন।
প্রশ্ন:; “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির”-এখানে 'যেথা’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন? উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : ‘যেথা'-র পরিচয় : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'নৈবেদ্য' কাব্যের ৭২ নং কবিতা 'প্রার্থনা' থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে
কবি এমন এক ভারতবর্ষের আকাঙ্ক্ষা করেছেন, যা হবে আদর্শনিষ্ট ও স্বর্গের মতো সুন্দর। যেখানে চিত্ত অর্থাৎ মানবমন থাকবে সকলপ্রকার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে; ক্ষুদ্রতা বা মানসিক অচলায়তনের গণ্ডির বেড়াজালে আবদ্ধ থাকবে
না মানুষের হৃদয়-মন; নির্ভীক মানসিকতায় এবং দীপ্ত ভঙ্গিতে প্রত্যেকে আপন আপন কর্মসাধনায় মগ্ন থাকবেন। আলোচ্য কবিতায় ‘যেথা বলতে এমনই এক আদর্শ ভারতের কথা বুঝিয়েছেন।
তাৎপর্য : কবিগুরু আমাদের গর্বের প্রাচীন ভারতের প্রশংসা করেছেন উদ্ধৃতাংশের মাধ্যমে। তৎকালে ভারতীয়দের মনে ভীতিগ্রস্ততা ছিল না। উন্নত শিরে, মেরুদণ্ড সোজা রেখে সকলপ্রকার বিরুদ্ধতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত ভারতীয়রা। কাপুরুষতা তাদের চরিত্রে ছিল না। ভয়শূন্য চিত্ত ও উচ্চশির থাকার কারণে নানাপ্রকার সংকীর্ণ আচার-বিচারের আবিলতার দ্বারা ভারতীয়দের পৌরুষকে খণ্ডিত করা যায়নি। চিত্তের দীনতা ও ভীতি থাকলে কখনোই জীবনযুদ্ধে জয়লাভ করা যায় না। এই সংসারে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে সর্বদাই যুদ্ধ চলছে। প্রতিমুহূর্তে জীবনকে বিপর্যস্ত করতে পারে অন্যায়। এরই বিরুদ্ধে সংগ্রামে সফল হয়েছে প্রাচীন ভারত। অকুতকয় ও উন্নত শির হলে ভারতবর্ষ আবার পূর্বাবস্থায় ফিরতে পারে—প্রশ্নোদ্ভূত অংশে কবি এমন ভারতকেই আকাঙ্ক্ষা করেছেন।
প্রশ্ন:: “জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,”- মুক্ত জ্ঞান' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন? গৃহের প্রাচীর কীভাবে বসুধারে খণ্ড ক্ষুদ্র করেনি আলোচনা করে বুঝিয়ে দাও।
উত্তর : ‘মুক্ত জ্ঞান’-এর পরিচয় : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘নৈবেদ্য’ কাব্যের ৭২ নং কবিতা ‘প্রার্থনা’ থেকে নেওয়া হয়েছে।
আলোচ্যমান কবিতায় কবি মুক্ত জ্ঞানের কথা বলেছেন। কবির মতে জ্ঞান কেবল পাঠ্যপুস্তকের মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না। পাঠ্যপুস্তক থেকে অর্জিত জ্ঞান হল খণ্ডিত বা সীমাবদ্ধ জ্ঞান। এখানে সংকীর্ণ চিন্তার সুযোগ থাকে। যে জ্ঞান প্রকৃতির
পারিপার্শ্ব থেকে সংগ্রহ করা হয়, তাতে থাকে হৃদয়ের ঔদার্য, চিন্তার স্বাধীনতা; ক্ষুদ্রতা, মলিনতা দ্বারা এই জ্ঞান আবদ্ধ নয়। এরূপ জ্ঞানকেই বলা হয় মুক্ত জ্ঞান। যেভাবে গৃহের প্রাচীর বসুধারে মুক্ত রেখেছে : কবির মতে বর্তমান ভারতবাসী জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে, কারণ জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র এখানে
সংকীর্ণতায় আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রকৃত জ্ঞানচর্চাকে গৃহের প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে বিশ্বমাঝে বিস্তৃত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ‘রাখে নাই ক্ষুদ্র খণ্ড করি' উক্তিটি ইঙ্গিতবাহী। কবি উপলব্ধি করেছেন প্রাচীন ভারতবর্ষে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র ছিল সংকীর্ণ চেতনার ঊর্ধ্বে। তুচ্ছ আচারের বালুরাশি দ্বারা আবদ্ধ ছিল না জ্ঞানচর্চার অঙ্গন। শিক্ষাকে আপন আপন গৃহের প্রাচীরের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখা হত না তৎকালে। ফলে ভারতের জ্ঞানচর্চার বার্তা পৌঁছে যেতে পেরেছিল মুক্ত পৃথিবীতে। এভাবেই গৃহের প্রাচীর বসুধারে ক্ষুদ্র খণ্ড করে রাখেনি।
প্রশ্ন:; “যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি—
পৌরুষেরে করে নি শতধা,”
—তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন? উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : ‘তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'নৈবেদ্য' কাব্যের ৭২ নং কবিতা 'প্রার্থনা' থেকে নেওয়া হয়েছে।
ভারতীয়রা যুগ যুগ ধরেই নানাপ্রকার 'আচার’ মেনে আসছে, যার অধিকাংশই অবৈজ্ঞানিক চিন্তার ফসল, যা সমাজের অগ্রগতির পরিপন্থী। বালুকারাশিও চলার পথকে মসৃণ না-করে অনেক বেশি বন্ধুর করে তোলে। অগ্রগমনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বালুকারাশি। কবি এখানে ‘তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি' বলতে আচার- বিচারের সংকীর্ণতাকেই বুঝিয়েছেন।
তাৎপর্য : আলোচ্যমান কবিতায় কবি কুণ্ঠাহীনভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের প্রশংসা করেছেন। কবির মতে প্রাচীন ভারতীয়দের চিত্ত ছিল ভয়শূন্য, উন্নত মস্তকে সাহসিকতাকে আশ্রয় করে তারা বিপদের বিরোধিতা করত।
তাদের বীরত্ব, হার না মানা মনোভাব, পৌরুষ ছিল অটল। কোনো ভয় বা প্রলোভনের দ্বারাই তাদেরকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা যেত না। তাদের নানাবিধ কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই পৌরুষের প্রকাশ ঘটত। তারা কখনোই ভীরুতার সাধনায় বিশ্বাসী নয়। তাদের লৌহসম কঠিন, বীরোদাত্ত পৌরুষ ছিল অভঙ্গুর। আচার-বিচারের সংকীর্ণতা কখনোই তাদের গ্রাস করেনি। কুণ্ঠাহীনভাবেই দেশের কাজে তারা শির বলিদান করতে পারত। কোনো পথেই তাদের অখণ্ড পৌরুষত্ব খণ্ডিত হয়নি। আলোচ্য উদ্ধৃতাংশের মাধ্যমে কবি এ কথাই বুঝিয়েছেন।
প্রশ্ন: “নিত্য যেথা/তুমি সর্ব কর্ম
চিন্তা আনন্দের নেতা,
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ, ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।”
- প্রসঙ্গ সহ উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর : প্রসঙ্গ : প্রশ্নোকৃত অংশটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ‘নৈবেদ্য’ কাব্যের অন্তর্গত ৭২ নং কবিতা 'প্রার্থনা' থেকে নেওয়া হয়েছে। পরমেশ্বরে বিশ্বাসী কবি উপলব্ধি করেছেন যে, এই জগৎ ও জীবনের স্রষ্টা হলেন পরমেশ্বর।
এখানে এমন কোনো কার্য বা ঘটনা ঘটে না যেখানে ঈশ্বরের পবিত্র স্পর্শ পড়ে না। কবির ধারণা বর্তমান ভারতীয়রা অলস, কর্মবিমুখ এবং চিন্তাশক্তিহীন। ফলে তারা তাদের পূর্বগৌরব হারিয়ে ফেলেছে। সেই অবস্থা থেকে ভারতবাসীকে জাগরিত করতে পারেন একমাত্র ঈশ্বরই। সেই প্রসঙ্গেই কবি উক্তিটি করেছেন। তাৎপর্য - কবির মতে প্রাচীন ভারতের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র ছিল উদার প্রকৃতির মতোই মুক্ত। বিবিধ প্রকারের সংস্কার বা আচার-অনুষ্ঠানের কখন
সেই জীবনধারাকে গ্রাস করতে পারেনি। তবে বর্তমানে শুষ্ক আচার-অনুষ্ঠানের জালে বন্দি ভারতীয়দের জীবন। মুক্ত জ্ঞানচর্চার অবকাশ নেই এখানে। যেন মোহনিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে ভারতবাসী। ভারতীয়দের এমন জড়তাগ্রস্ততা, মোহাচ্ছন্নতা দূর করতে পারেন কেবল সৃষ্টিকর্তাই; তিনিই সকল কর্ম-চিন্তা-আনন্দের কারণ, তিনিই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। তাই পরমেশ্বরের কাছে কবি প্রার্থনা করেছেন—পরমপিতা যেন কঠোর আঘাতের মাধ্যমে ভারতীয়দের তন্ত্রাচ্ছন্নতার অবসান ঘটিয়ে, তাদের প্রাচীন গৌরবের স্থানে
উন্নীত করেন। কবির স্বর্গ কোনো অলৌকিক স্থান নয়; যেখানে ভারতীয়রা নির্ভীক চিত্তে উন্নত মস্তকে, উদারভাবে জ্ঞানচর্চায় মগ্ন থাকতে পারে সেই জাগতিক স্বর্গই কবির কাম্য। ভারতীয়দের জাগতিক উন্নতি ঘটিয়ে সেই স্বর্গে স্থাপন করার আকাঙ্ক্ষাই করেছেন কবি।
