তিমির হননের গান কবিতা সকল প্রশ্নের উত্তর‌। দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা। - school book solver

Tuesday, 2 December 2025

তিমির হননের গান কবিতা সকল প্রশ্নের উত্তর‌। দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা।

 


তিমির হননের গান কবিতা জীবনানন্দ দাশ

 দ্বাদশ শ্রেণি বাংলা


উৎস
'তিমির হননের গান' কবিতাটি ‘সাতটি তারার তিমির' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটি ১৩৫০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে ১৩৫৫
বঙ্গাব্দে (১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে) জীবনানন্দ দাশের 'সাতটি তারার তিমির' কাব্যগ্রন্থে ২৮ নং কবিতারূপে 'তিমির হননের গান' কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হয়।
কবিতার ভাববস্তু
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালীন বাংলার সমাজজীবন ছিল অস্থিরতাময়, তমসাচ্ছন্ন। এই বিশ্বযুদ্ধের হাত ধরেই ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৩৫০ বঙ্গাব্দে) বাংলার বুকে নেমে আসে পঞ্চাশের মন্বন্তরের যন্ত্রণাকাতর দিনগুলি। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ কেবল মানুষের প্রাণকে কেড়ে নেয়নি, কেড়ে নিয়েছে মানবিক আশা-ভরসার স্থানগুলিকেও। সীমাহীন তামসিকতায় আক্রান্ত হয়েছিল বাংলার জনজীবন। এমনই পরিস্থিতিতে 'পত্রিকা' নামক সাময়িকপত্রে ১৩৫০ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় জীবনানন্দ দাশের 'তিমির হননের গান' কবিতাটি। ‘তিমির' শব্দের অর্থ অন্ধকার। 'হনন' শব্দের অর্থ হত্যা, বধ। তাহলে "তিমির হনন’হল অন্ধকারকে হত্যা করা। কাব্যের দৃষ্টিতে যার অর্থ দাঁড়ায়—অন্ধকারের অবসান ঘটানো। এই অন্ধকার হল সামাজিক, সাংস্কৃতিক, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়জনিত কারণে সভ্যতার বুকে নেমে আসা কালিমাময় দিন। যে মানসিক তিমিরতা মানুষের জীবনকে তমসাচ্ছন্ন করেছে, তাকে দূরে সরিয়ে আলোকের দিকে এগিয়ে যাওয়াই 'তিমির হনন' অর্থাৎ তিমিরের অবসান ঘটানো—এমন কথাই ধ্বনিত হয়েছে জীবনানন্দের কবিতায়। যুগ যুগ ধরে নানা সংস্কারের আবর্তে জড়িয়ে মানুষের মনের মধ্যে গড়ে ওঠে স্বর্গ-মর্ত্য, পাপ-পুণ্যের চেতনা আর এসবের দ্বারা চালিত হয় মধ্যবিত্তের মনোজগৎ। আসলে স্বর্গের ভাবনা তো জীবনের সুখের দিক, আলোর দিককে দ্যোতিত
করে। অন্যদিকে নরকচেতনা দুঃখের, তিমিরের দিককে চিহ্নিত করে। মানুষ যেমন দুঃখকে চায় না, তেমনই চায় না তিমিরকেও। দুঃখকে অতিক্রম করে তবে সুখের দিকে যাত্রা করা যায়। একইভাবে তিমিরকে অতিক্রম করে তবেই আলোকের আগমন ঘটানো যায় জীবনে। স্বাভাবিকভাবে তাই মানুষ 'তিমিরবিনাশী”। বলাবাহুল্য তিমিরবিনাশী মনোভাবই মানুষের আজন্ম লালিত মূল্যবোধ। এই মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে নাগরিক জীবনে—এ কথা অবশ্যই সত্য। তবে এ কথাও সত্য যে-বিবেকবোধসম্পন্ন মানুষ সেই মূল্যবোধকে হৃদয়ে সঞ্জীবিত রাখেন এবং সমাজ থেকে তিমিরকে বিনাশ করার চেষ্টায় নিজেকে মগ্ন রাখেন। অন্যদের মধ্যেও এই বোধের বিকাশ ঘটাতে তৎপর হন। নৈরাজ্য, হতাশা, যন্ত্রণা থেকে আলোর দিকে ধাবিত হওয়ার নামই তো জীবন। আর জীবনের আকাঙ্ক্ষার কথাই আলোচ্য কবিতায় তুলে ধরেছেন কবি। একদিকে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের দুঃখযন্ত্রণা, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির তিমিরবিলাসীতা কবিকে যন্ত্রণাদীন করেছে। সৃষ্টি-বিমুখতা, যুগের বন্ধাত্ব,
মূল্যবোধের অবক্ষয় বর্তমান মানবজীবনে ডেকে এনেছে তামসিকতা। তবু কবি আশাবাদী—এই তামসিকতার অবসান ঘটবেই। সুদ্ধ চেতনার জাগরণ আর মানবপ্রেমের মেলবন্ধনেই অবসান ঘটানো সম্ভব তিমিরের। সংকট থেকে বেরিয়ে আসবেই মানুষ, ঘটবেই তিমিরের অবসান, আলোয় উদ্ভাসিত হবে সভ্যতা।
কবিতার বিষয়বস্তু
কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত 'তিমির হননের গান' কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৫০ বঙ্গাব্দে ‘পত্রিকা' নামক সাময়িকপত্রে। অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং বাংলার বুকে নেমে আসা পঞ্চাশের ভয়ানক দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত হয়েছে কবিতাটি। স্বাভাবিকভাবেই সমকালীন সমাজভাবনার প্রতিফলন ঘটেছে আলোচ্য কবিতায়। বাংলার তখন ভয়ানক দুর্দিন। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ মানুষের প্রাণকেই শুধু কেড়ে নেয়নি, নিয়েছে মানসিক আশা-ভরসার জায়গাগুলিকেও। কোথাও যেন শান্তি বজায় ছিল না। সীমাহীন এক আঁধার নেমে এসেছিল বাংলা তথা বাঙালির জীবনযাত্রায়। সেই অন্ধকারের কৃষ্ণ-গহ্বর থেকে আলোর আহ্বান জানানোই তো কবি-সাহিত্যিকদের উদ্দেশ্য। সেই মর্মসত্যটিই কবি জীবনানন্দ তুলে ধরেছেন আলোচ্য তিমির হননের গান' কবিতায়।
সভ্যতার বুনিয়াদ রচনা করেন আমজনতা। তারা কখনোই সভ্যতার বিনাশ চায় না, তারা স্রষ্টা – সৃষ্টিসুখের উল্লাসেই মেতে থাকতে চায় তারা।
কবি-সাহিত্যিকগণও সেই সৃষ্টিরই মদিরাপানে তৃপ্ত হয়ে সাহিত্যরচনায় আত্মনিয়োগ করেন। তাই তাঁরাও চান সমাজের বুক থেকে বিনাশ হোক
তিমিরের। তিমিরকে হনন করেই আলোর জাগরণ ঘটাতে তৎপর হন কবি-সাহিত্যিকগণ। তিমির হননের গান' কবিতা তেমনই এক সাহিত্য-সৌরভ, যেখানে কালের যন্ত্রণায় দগ্ধ কবি আলোর উৎসমুখে পৌঁছে যাওয়ার বার্তা দিয়েছেন পাঠককে। রাতের দুঃস্বপ্নকে কাটিয়ে মানুষ পৌঁছে যেতে চায় ভোরের আলোক-সাগরে; দুঃখ, জড়া, নৈরাশ্য, অনাচারের অমানিশা অতিক্রম
করে আমজনতা অবগাহন করতে চায় আনন্দ, তারুণ্য, আশারূপ সুখ-শান্তির পারাপারে। সমস্ত সংঘাতের মধ্যে লীন হয়ে থাকে কল্যাণের আকাঙ্ক্ষা। তাই কবি জীবনানন্দ চেয়েছেন সকল প্রকার তমসাকে ছিন্ন করে এগিয়ে যেতে। কারণ তিনি তিরবিলাসী নন, তিমিরবিনাশী সত্তার অধিকারী। তাই নৈরাজ্য, যন্ত্রণা, আত্মকেন্দ্রিকতা থেকে বেরিয়ে এসে মানবসমাজকে তিমির হননের গান শোনাতে চেয়েছেন কবি জীবনানন্দ। মধ্যবিত্তমদির জগতের তিমিরবিলাসী মানসিকতা সমাজকে অন্ধকারের দিকেই নিয়ে যায়। এটা নগর জীবনের করুণ কাহিনি। সভ্যতার এই কালিমাময় রূপ দেখে আতঙ্কিত কবি নির্জনতায় সংগীত রচনা করলেও আলোচ্য কবিতায় সূর্যকরোজ্জ্বল আশাবাদের কথাই ধ্বনিত হয়েছে।

নামকরণ
সাহিত্যের একটি প্রধান অঙ্গ হল নামকরণ। প্রসঙ্গত বলা যায়।
নামকরণের মাধ্যমেই রচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আগাম ধারণা করা যায়।
নামকরণ নানা আঙ্গিকে হতে পারে, যেমন- বিষয়কেন্দ্রিক, চরিত্র প্রধা ব্যঞ্জনাধর্মী ইত্যাদি। এবার আলোচনা করে দেখা যাক যে, কবি জীবনানন দাশ রচিত 'তিমির হননের গান' কবিতার নামকরণটি সার্থক কিনা।
একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, অন্যদিকে পঞ্চাশের মন্বন্তর - বাংলার বুকে ঘটে যাওয়া এই দুই সভ্যতার সংকট সৃষ্টিকারী ঘটনার প্রেক্ষাপটে রচিত "তিমির হননের গান' কবিতাটি। বাংলা ও বাঙালির জীবনে তখন এক সীমাহীন অন্ধকার। সেই অন্ধকারের কৃষ্ণগহ্বর থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বান জানান সাহিত্যিকগণ তাঁদের রচনার মাধ্যমে। আলোচ্য 'তিমির হননের গান' কবিতাটি
যেন তারই মর্মবাণী। মানবসভ্যতার গভীর সংকটকেই কবি ‘তিমির' বলে উল্লেখ করেছেন। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা, নাগরিক সভ্যতার রুচিহীনতা সভ্যতার বুঝে ডেকে এনেছে ঘোর তিমির। একদিন যা ছিল সুন্দর, তা আর সুন্দর রইল না। হ্রদে, নদীর ঢেউয়ে পরস্পরের সঙ্গে দু-দণ্ড হৃদয়ের কথা বলে জীবনে উঠত আলোড়ন, বর্তমানে আর সেই আলোড়ন ধরা দেয় না। ‘আমরা’ অর্থাৎ মধ্যবিত্ত ভুল সম্প্রদায় এক স্বপ্নের মদিরতা হৃদয়ে মেখে আত্মতৃপ্ত হতেই ভালোবাসি। প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার চেষ্টায় সূর্যালোক না-থাকলেও সূর্যালোকের প্রত্যাশায় আমরা হাসি-খেলায় মেতে উঠি। সমাজের অধিকাংশ মানুষ অসহায়, দরিদ্র শ্রেণির। মধ্যবিত্তের বিষাদের থেকেও তাদের জীবন ঘন অন্ধকারে ঢাকা। তবু আলোর প্রত্যাশায় মানুষ বাঁচে, তিমিরকে নাশ করতেই চায় সাধারণ জনগণ। কারণ তারা মধ্যবিত্তের মতো ‘তিমিরবিলাসী' নয়, তারা কষ্টে-ক্লিষ্টে প্রাণটুকু বাঁচিয়ে রেখেও তিমিরবিনাশী' হতে চায়। সৌন্দর্যের অভাবে যে জীবন মরে যায়, তা অনুভব করে না তিমির বিলাসীরা কিন্তু আমজনতা তিমিরকে ছিন্ন করে মনোরম আলোয় আনন্দে মেতে ওঠার প্রত্যাশা করে।
তিমিরকে সাধারণ জনগণ কখনোই মেনে নিতে চায় না। যুগের যন্ত্রণায় কাতর হয়েও একটা আরাম পাওয়ার জন্য তিমিরকে হত্যা করতে চায় তারা। আলোর অভিমুখে যাত্রা করতে চায় তারা অথচ তিমিরবিলাসী হওয়াটাই যেন নাগরিক জীবনের করুণ পরিণতি। জীবনানন্দের ভাষায়—“মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি।” তুচ্ছ ভোগসুখেই এরা তৃপ্ত, এরা আত্মকেন্দ্রিক।

অন্যদিকে সভ্যতার বুনিয়াদ গড়ে তোলে যে দরিদ্র মানুষজন তারা সংগ্রাম করে বাঁচার—লঙ্গরখানার অন্ন খুঁটে খায়। তবু তারাই অন্ধকারের উৎস থেকে আলো খুঁজে আনার চেষ্টা করে চলেছে অনবরত। সভ্যতার পিলসুজ সাধারণ নরনারী পথ চলতে চলতেই অন্ধকারের কৃপ হতে মুক্ত হয়ে আলোর সাগরে অবশ্যই একদিন অবগাহন করবে—এটাই কবির বিশ্বাস।
সমগ্র কবিতার প্রেক্ষাপটেই কবি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তিমিরকে হত্যা করা অর্থাৎ অন্ধকারের অবসানকল্পেই আমাদের যাত্রা। আমরা তিমিরবিলাসী নই, তিমিরবিনাশী আমরা। তিমির বিনাশের অদম্য আকাঙ্ক্ষার কথাই আলোচা কবিতায় ধ্বনিত হয়েছে এবং তিমির হননের ব্যঞ্জনাই দ্যোতিত হয়েছে। আলোচ্য কবিতাটিতে। তাই বলা যায় যে তিমির হননের গান' নামকরণটি সার্থক হয়ে উঠেছে।

সংক্ষিপ্ত প্রশ্নের উত্তর

প্রশ্ন: জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পর প্রকাশিত এমন দুটি কাব্যপ্রাণের নাম উল্লেখ করো এবং কবি ভারত সরকার কর্তৃক কোন্ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন?
উত্তর : মৃত্যুর পরে প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের দুটি কাব্যগ্রন্থ হল—‘রূপসী বাংলা' (১৯৫৭), 'বেলা অবেলা কালবেলা' (১৯৬১)।
কবি জীবনানন্দ ভারত সরকার কর্তৃক সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হন।

প্রশ্ন: 'তিমির হননের গান' কবিতাটির মূল কাব্যগ্রন্থের নামসহ প্রকাশকাল উল্লেখ করো।
: উত্তর : 'তিমির হননের গান' কবিতাটি 'সাতটি তারার তিমির' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত।

তিমির হননের গান' কবিতাটি ১৩৫০ বঙ্গাব্দে প্রথম প্রকাশিত হয় নামক সাময়িকপত্রে। পরবর্তীকালে ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে 'সাতটি তারার
তিমির কাব্যে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় কবিতাটি।

প্রশ্ন: 'কোনো হ্রদে/কোথাও নদীর ঢেউয়ে’–কারা, কী করেছে?
উত্তর : আবহমান কাল ধরেই মানুষ মানুষের সঙ্গে মিশতে চেয়েছে, আত্মীয়তার বন্ধন গড়তে চেয়েছে। হ্রদ বা নদীর ঢেউ তো প্রতীক, আসলে মানুষ মনের শান্তি খুঁজতে পরস্পরের সান্নিধ্য চেয়েছে। নাগরিক সভ্যতার মলিনতা থেকে দূরে সরে গিয়ে অশান্ত হৃদয়কে স্নিগ্ধ করার জন্য 'আমরা' অর্থাৎ মধ্যবিত্ত মানসিকতাসম্পন্ন মানুষেরা পারস্পরিক সাহচর্যে বসবাস করেছিল।

প্রশ্ন: ‘দু-দণ্ড জলের মতো মিশে’—কথার অর্থ লেখো।
উত্তর : জলের মতো মিশে বলতে বোঝানো হয়েছে সহজ-সুন্দরভাবে মেশাকে। মানুষ মানুষকে ভালোবাসতে চায়, পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদানের মাধ্যমে বন্ধুত্বকে নিবিড় করতে চায়, জীবনকে সুন্দরভাবে গতিময় করে তুলতে চায়। আর এটা তখনই সম্ভব হয় যদি তাদের মধ্যে পারস্পরিক মনের মিল গড়ে ওঠে, যা তাদের মনকে ভরিয়ে রাখতে পারে অনাবিল স্নিগ্ধতায়। এমন সরলভাবে মেলামেশাকেই জলের মতো মেশা বলেছেন কবি।

প্রশ্ন: জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামোল্লেখ করে তাঁর লেখা অন্যান্য কয়েকটি কাব্যের নাম লেখো।
উত্তর : কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ হল 'ঝরাপালক' (১৯২৮)। জীবনানন্দ দাশ রচিত অন্যান্য কয়েকটি কাব্য হল – 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' (১৯৩৬), ‘বনলতা সেন' (১৯৪২), ‘মহাপৃথিবী' (১৯৪৪), 'সাতটি তারার তিমির’(১৯৪৮), ‘রূপসী বাংলা' (১৯৫৭), ‘বেলা অবেলা কালবেলা' (১৯৬১)।
প্রশ্ন: জীবনানন্দ দাশ রচিত কয়েকটি গদ্য রচনার নাম লিখে তাঁর সর্বাধিক প্রচারিত উপন্যাসটির নাম লেখো।
উত্তর : জীবনানন্দ দাশ রচিত কয়েকটি গদ্য-রচনা হল – 'মাল্যবান', 'কারুবাসনা',।‘জলপাইহাটি’, ‘জীবনপ্রণালী’, ‘বাসমতীর উপাখ্যান', 'প্রেতিনীর রূপকথা' ইত্যাদি।

জীবনানন্দের সর্বাধিক প্রচারিত উপন্যাসটি হল—'মাল্যবান'।

প্রশ্ন:--“আমাদের জীবনের আলোড়ন – ”– এমন শব্দগুচ্ছ কবি কোন্ প্রসঙ্গে।ব্যবহার করেছেন?
উত্তর : একদা আমাদের পূর্বপুরুষগণ পরস্পর পরস্পরের সাথে মিলেমিশ সভ্যতার বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিলেন। সহজসরল সম্পর্কের মাধ্যমে আনন্দ-হাসিতে মেতে উঠতেন তাঁরা। সুখ-দুঃখ, কান্না-হাসিতে আলোড়িত হত তাঁদের জীবন।
যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষের কড়াল গ্রাসে পতিত হয়ে মানুষের জীবন থেকে হারিয়েই যেতে বসেছে সুস্থ-সুন্দর-সরল অনুভূতিগুলি। এই প্রসঙ্গে কবি জীবনানন্দ দাশ 'তিমির হননের গান কবিতার প্রশ্নোকৃত শব্দগুচ্ছ ব্যবহার করেছেন।

প্রশ্ন:- “আমরা হেসেছি,/আমরা খেলেছি; ”– 'আমরা' বলতে কবি কাদের বুঝিয়েছেন?
উত্তর : তিমির হননের গান' কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ বলতে চেয়েছেন—আমাদের পূর্বপুরুষগণই একদা গড়ে তুলেছিলেন সভ্যতার বুনিয়াদ । মানুষে মানুষে পারস্পরিক সহযোগিতার ও সহমর্মিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সহজসরল সম্পর্ক গড়েছিলেন তাঁরা। তাঁরাও কিন্তু মধ্যবিত্ত মানসিকতাসম্পন্নই ছিলেন। যদিও বর্তমানের প্রেক্ষাপটে মধ্যবিত্তের জীবনদর্শন আর আগের মতো নেই। আমরা” বলতে কবি নিজে এবং মধ্যবিত্ত মানসিকতাসম্পন্ন পূর্বপুরুষদের বুঝিয়েছেন।

প্রশ্ন:-“সেই সব রীতি আজ মুতের চোখের মতো তবু—”–কবি কোন্ রীতির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন?
উত্তর : কবি জীবনানন্দ দাশের কথার মানুষ একদা নির্মল হৃদয়ে হাসি-আনন্দে। নেচে উঠেছিল। সেখানে কোনো গ্লানি, মলিনতা ছিল না, মানুষে মানুষে ছিল শুদ্ধ প্রেম। নির্মল আকাশের মতোই তাদের চোখের ভাষা ছিল আবিলতাহীন।
জীবনকে ভালোবেসে শিখতে চেয়েছে তারা। জলের মতোই সহজভাবে মিশেছে তারা। শদ্ধ প্রেম, আবিলতাহীন চোখের ভাষা, জীবনকে শিখতে চাওয়া—এইসকল রীতির প্রতিই কবি ইঙ্গিত করেছেন।

প্রশ্ন:-  'আজ মৃতের চোখের মতো' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : একদা আমাদের পূর্বপুরুষগণ নির্মল হাসি-খেলায় মেতে উঠেছিলেন। কারণ তাঁরা পরস্পর পরস্পরের সাথে জলের মতো সহজভাবে মিশতেপেরেছিলেন। আজ আর সেই দিন নেই। যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ কেড়ে নিয়েছে মানুষের মনের শান্তি। মৃত মানুষের চোখ ফ্যাকাসে ঘোলাটে হয়ে যায়। বোঝাই যায় তা প্রাণহীন। ‘মৃতের চোখের মতো' বলতে মানুষের প্রাণহীন আচরণ বা সম্পর্ককেই বুঝিয়েছেন কবি। এমন সম্পর্ক আন্তরিকতাশূন্য, শুষ্ক। এখানে
নেই নিটোল ভালোবাসা।

প্রভাব ফেলেছিল। জীবনানন্দ দাশের 'তিমির হননের গান' কবিতায় তার ইঙ্গিত দিয়েছেন কবি। মধ্যবিত্ত শ্রেণি আপনাদের বিলাসী জীবন থেকে বেরিয়ে আসেনি, অন্যদিকে দরিদ্র শ্রেণির দুঃখ-বেদনার কোনো অন্ত ছিল না।
লঙ্গরখানায় খাদ্যের সারিতে দাঁড়াতে হয়েছে বাঁচার তাগিদে। কষ্টে-ক্লিষ্টে অম্ল খুঁটে খেতে হয় তাদের। 'অন্তহীন বেদনার পথে' বলতে তাদের জীবনের।করুণ পরিণতির কথাই বুঝিয়েছেন কবি।

যায়; সেই নির্মল আকাশের মতো মলিনতাহীন চোখ নিয়ে একদা মানুষ মেতে উঠেছিল হাসি-খেলায়। হৃদয়ের শুদ্ধতা ধরা পড়ত চোখের সহজসরল দৃষ্টিতে, কোনো গ্লানি সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারত না। এমন পরিচ্ছন্ন মানসিকতাকেই উদ্ধৃতাংশের মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছেন কবি।

প্রশ্ন:- “লঙ্গরখানার অন্ন খেয়ে”—লঙ্গরখানা কী?
উত্তর : কোনো স্থানে বন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা ঘটলে আর্ত, পীড়িত সাধারণ জনগণ খাদ্য সমস্যায় পড়েন। তখন সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে পীড়িত মানুষদের জন্য অন্নের ব্যবস্থা করা হয়। একেই লঙ্গরখানা বলা হয়। ১৩৫০ বঙ্গাব্দের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে বহুস্থানে লঙ্গরখানা স্থাপন করা হয়েছিল। খাদ্যের জন্য সেখানে নিরন্ন দরিদ্র মানুষগণ লাইনে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করতেন। কখনো-কখনো দেখা যেত লঙ্গরখানার একমুঠো অন্নের জন্য মানুষের মধ্যে মারামারির মতো ঘটনাও।

প্রশ্ন:- “নর্দমার থেকে শূন্য ওভারব্রিজে উঠে”–এখানে কাদের, কোন মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে?
উত্তর : আধুনিক যুগযন্ত্রণায় সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয় সমাজের নীচুতলার মানুষদের। দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া তাদেরকে ঘিরে ধরে। লঙ্গরখানায় খাদ্যের সারিতে দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় কেটে যায় তাদের। তবুও তারা আলোকময় জীবনের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে, জীবনটা বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে। উদ্ধৃতাংশে এমন সাধারণ শ্রেণির স্বপ্নমদিরতা ও।বেঁচে থাকার মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে।

প্রশ্ন:-  “নক্ষত্রের জ্যোৎস্নায় ঘুমাতে বা ম'রে যেতে জানে।”—কবি কোন্ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত চরণটি উত্থাপন করেছেন?
উত্তর : যুগের যন্ত্রণায় কাতর হয়ে সাধারণ শ্রেণির মানুষ সামান্য বিশ্রাম পেতে চায়। নক্ষত্রের আলো তো জোরালো নয়, তাতে আঁধার দূর হয় না। কিন্তু দরিদ্র শ্রেণির মানুষ সামান্যতেই খুশি। তাদের আলোর তীব্রতার প্রয়োজন নেই, নক্ষত্রের মৃদু আলোতেই তারা অনেকটা হাসি খেলায় মেতে উঠতে পারে। মধ্যবিত্তের বেদনা, নিরাশার ডিঙি পেরিয়ে টিকে আছে আমজনতা।
এমন আলোচনা প্রসঙ্গেই কবি জীবনানন্দ উদ্ধৃত চরণটি উত্থাপন করেছেন।

প্রশ্ন:- ‘মধ্যবিত্তমদির জগৎ' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : সমাজে এক শ্রেণির মানুষ আছে, যারা নিজেদের স্বার্থের গণ্ডির বাইরে গিয়ে ভাবতে পারে না। তারা অর্থনৈতিক দিক থেকে স্বচ্ছল, তারা
স্বপ্নবিলাসী কিন্তু তারা আত্মকেন্দ্রিক। তারা ভোগবাদী মানসিকতায় মগ্ন হয়ে অনেকক্ষেত্রেই রুচিহীন, বিচারহীনভাবে বেঁচে থাকতেই ভালোবাসেন। তারা তিমিরবিলাসী—বৃহত্তর মানবজগতের কথা এরা ভাবতেই পারে না।

প্রশ্ন:- তিমির হননের গান' কবিতায় কবি ‘মৃগনাভি' শব্দটি কোন্ প্রসঙ্গে উত্থাপন করেছেন কেন?
উত্তর : হরিণের নাভি থেকে নিঃসৃত সুগন্ধি বিশেষ হল কস্তুরী। মূলত পুরুষ হরিণের নাভির কাছে অবস্থিত এক বিশেষ গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় এই সুগন্ধি। তিমির হননের গান’ কবিতায় ‘নাভি' শব্দের মাধ্যমে কবি জীবনানন্দ দাশ বোঝাতে চেয়েছেন—যা আমিষাশী ঘ্রাণকে বয়ে আনে। আধুনিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজের সংকটেও বেদনাহীন। কারণ তারা কেবল নিজেদের বিলা
জীবন নিয়েই ব্যস্ত। নাগরিক জীবনের অপরিমিত ভোগবাসনা প্রসঙ্গেই কঠিন'মৃগনাভি'-র বিষয়টি উত্থাপন করেছেন।

প্রশ্ন:-'অন্তহীন বেদনার পথে' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও মন্বন্তর বাংলার জনজীবনে ধ্বংসাত্মক 

প্রশ্ন:- “তিমিরবিনাশী হতে চাই”—এখানে কবির কোন্ মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে?
উত্তর : সাহিত্যিকগণের রচনায় সমাজের প্রকৃষ্ট ছবি ধরা পড়ে। সেইসঙ্গে লেখকের মনের গভীরে জমে থাকা ইচ্ছার প্রকাশও ঘটে সাহিত্যের দর্শনে।
কবিগণ কখনও সভ্যতার সংকট দেখে নীরব থাকতে পারেন না। সমাজের অন্ধকার নৈরাজ্যের অবসান চান তারা। তাঁরা চান সমাজকে শোধন করতে। অন্ধকারের উৎস হতে আলোর পথে যাত্রার পথনির্দেশ করেন কবিগণ।
বিলাসীতাপূর্ণ গড্ডলিকা প্রবাহে তাঁরা ভাসমান নন। আলোচ্য অংশে কবির সুস্থ ও উদার মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে।


প্রশ্ন-  ‘তিমির হননের গান' কবিতাটির উৎস উল্লেখ করে কোন্ প্রেক্ষাপটে কবিতাটি রচিত হয়েছে লেখো।
উত্তর : ‘তিমির হননের গান' কবিতাটির উৎস হল জীবনানন্দ দাশ রচিত সাতটি তারার তিমির' কাব্যগ্রন্থ।
বাংলার মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত হয়েছে ‘তিমির হননের গান' কবিতাটি। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা, অন্যদিকে পঞ্চাশের প্রাণঘাতী মন্বন্তর বাংলার জনজীবনে অপরিসীম সংকট ডেকে এনেছিল। মানুষের মনে ছিল না শান্তি, ছিল না আগামীতে ভালো থাকার কোন আশ্বাস। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ শুধু মানুষের প্রাণকেই কেড়ে নেয়নি, নষ্ট করেছিল
মানসিক আশা-ভরসাকেও। একদিকে মানুষের মৃত্যুমিছিল, অন্যদিকে সম্পদের বিনাস। এমনই এক তমসাচ্ছন্ন প্রেক্ষাপটে কবি জীবনানন্দ ‘তিমির হননের গান' কবিতাটি রচনা করেছেন।

প্রশ্ন:-  “সেই জের টেনে আজো খেলি।” –'সেই জের' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তর : জীবনানন্দ দাশের 'তিমির হননের গান' কবিতাটি পাঠ করে বোঝা যায় আমাদের পূর্বপুরুষগণ গৌরবময় ঐতিহ্য বহন করতেন, তাঁরা পরস্পর পরস্পরকে নির্মল হৃদয়ে ভালোবাসতেন। জলের মতো সহজসরলভাবে মিশতে পারতেন তাঁরা। এভাবেই তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন সভ্যতার বুনিয়াদ। বর্তমানে সেই সুস্থ পরিবেশ না থাকলেও আলোর পথ চেয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যকে সামনে রেখেই। 'সেই জের' বলতে আমাদের সুন্দর ঐতিহ্যকেই বুঝিয়েছেন কবি, যাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।

প্রশ্ন:- “সূর্যালোক নেই—তবু –”–উদ্ধৃতাংশের প্রসঙ্গ নির্দেশ করো।
উত্তর : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ১৩৫০-এর মন্বন্তর বাংলার বুকে নামিয়ে এনেছিল ভয়ানক সংকটকালীন পরিস্থিতি। মানবসভ্যতায় নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা। কোথাও যেন কোনো আলোর অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আমজনতাকে তো প্রাণের দীপশিখাকে প্রদীপ্ত রাখতে হবে। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত আলোকের সন্ধান করতে হবে। সূর্যালোকের প্রত্যাশায় মনের হাসিটুকুকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। এই প্রসঙ্গেই প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি ব্যবহার করেছেন কবি।

প্রশ্ন:- “স্বতই বিমর্ষ হ’য়ে ভদ্র সাধারণ চেয়ে দ্যাখে”—ভদ্র সাধারণ স্বতই বিমর্ষ কেন?

উত্তর : কবি জীবনানন্দ দাশ ‘তিমির হননের গান' কবিতায় উল্লেখ করেছেন ভদ্র সাধারণ নিজে নিজেই বা নিজের থেকেই তাকিয়ে দেখে সভ্যতার বর্তমান পঙ্কিল রূপকে। তারাও হয়তো বুঝতে পারে বর্তমানে কোথাও শুদ্ধ প্রেম, আন্তরিকতা পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই ভদ্র-সাধারণ মধ্যবিত্ত বিলাসী মনোভাবাপন্ন শ্রেণি নিজেদের লোভকে সংবরণ করতে অক্ষম। সীমাহীন তাদের পাওয়ার বাসনা কখনোই পরিতৃপ্ত হয় না, তাই এই শ্রেণি স্বতই বিমর্ষ।

প্রশ্ন:-“সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে”—উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য লেখো
উত্তর : প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি জীবনানন্দ দাশ রচিত 'তিমির হননের গান' নামক কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। তমসাচ্ছন্নতা থেকে বেরিয়ে আসার আকাঙ্ক্ষা ব্যাক্ত হয়েছে চরণটিতে। যুগে যুগে নানা বাধাকে অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হয় মানুষকে। একদা মানুষ পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মিশেছে সহজ সরলভাবে। আজ সেই সরলতা নেই কিন্তু মানুষ সর্বদা ছুটে যেতে চায আলোর দিকে। সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হতে চায় সাধারণ জনগণ। জীবনের ক্লান্তিময় অন্ধকারকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত করে নিজেদেরকে। তাই রাতের কালিমা নয়, ভোরের আলোর প্রত্যাশাতেই যাত্রা করে মানুষ।

প্রশ্ন: “হয়তো বা জীবনকে শিখে নিতে চেয়েছিলো।”—প্রসঙ্গসহ আলোচনা করো।
উত্তর : প্রশ্নোক্ত উদ্ধৃতিটি জীবনানন্দ দাশ রচিত 'তিমির হননের গান' নামক কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। একদা আমাদের পূর্বপুরুষগণ পারস্পরি সাহচর্যে, ভালোবেসে জীবনকে অতিবাহিত করেছিলেন। সেই প্রসঙ্গেই চরণটি ব্যবহার করেছেন কবি।
মানুষ ভালোবাসতে চায়; সহমর্মিতা, ভালোবাসার বন্ধনে নিজেদের জড়িয়ে রাখতে চায়। সেই চাওয়া থেকেই সহজসরল সম্পর্ক গড়ে তুলে
সভ্যতার বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষগণ। অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে আলোর অভিমুখে তাঁরা এগিয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন। জীবন-সাগরে ভেসে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে শিখেছিলেন তাঁরা। উদ্ধৃতাংশের মাধ্যমে কবি এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন - “অন্য এক আকাশের মতো চোখ নিয়ে”—উদ্ধৃতাংশের মাধ্যমে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি জীবনানন্দ দাশ রচিত 'তিমির হননের গান' নামক কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধ ও মন্বন্তরের ভয়ংকর পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আলোর সন্ধানে অগ্রসর হয়েছিল মানুষ, সেই প্রসঙ্গেই চরণটি আলোচিত হয়েছে।
‘অন্য এক আকাশের মতো' বলতে কবি বুঝিয়েছেন— সংকটের কালে মেঘে সমাচ্ছন্ন আকাশ নয়, হিংসা আর বিদ্বেষের বিষবাষ্পে আদৃত আকাশ নয়; যে আকাশ নির্মেঘ, যে আকাশে সূর্যের শুদ্ধ হাসি দর্শন করা 

প্রশ্ন- “একদিন ভালোবেসে গেছি।”—কে, কীভাবে ভালোবেসেছে?
উত্তর : কবি জীবনানন্দের 'তিমির হননের গান' কবিতার কথক এবং পূর্বপুরুষগণ ভালোবেসেছেন। প্রকৃতপক্ষে মধ্যবিত্ত শ্রেণিও পূর্বে ভালোবাসার সম্পর্কে আবদ্ধ থাকত। একদা মানুষ সহমর্মিতা, সহযোগিতা, ভালোবাসার সম্পর্কে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে আবদ্ধ হত। মানুষের মনে আনন্দ থাকত। তাদের হাসি-খেলায় ছিল না কোনো গ্লানি। নির্মেঘ আকাশের মতোই হৃদয় ছিল নির্মল। জীবনকে তারা নানা অভিঘাতের মাধ্যমে শিখে নিতে চেয়েছিল। আমাদের পূর্বপুরুষগণও মধ্যবিত্ত মানসিকতাসম্পন্ন ছিলেন, তবে তা আজকের মতো আর্থপরতায় পূর্ণ ছিল না। তাঁরা অনেক মানবিক ছিলেন—এটা আমাদের গর্বের বিষয়। এমন গর্বিত ঐতিহ্য আমাদের সঙ্গে আছে, এই ঐতিহ্যে নেই কোনো মলিনতা, নেই কোনো গ্লানি। আমাদের এই ঐতিহ্য স্মরণীয় আমাদের জীবনে। কারণ এই ঐতিহ্যকে পাথেয় করেই আমরা এগিয়ে চলেছি। এভাবেই পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকারকে একদিন ভালোবেসেছি আমরা।
প্রশ্ন,-“হেমন্তের প্রান্তরের তারার আলোক।"—উদ্ধৃত চরণটির প্রসাসহ তাৎপর্য লেখো।
উত্তর : প্রশ্নোদ্ধৃত অংশটি জীবনানন্দ দাশ রচিত 'তিমির হননের গান' নামক কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের গৌরবময় ইতিহাস আমরা বহন করেছি কিন্তু বাস্তবে বর্তমান পরিস্থিতি নৈরাশ্যজনক। সেই প্রসঙ্গেই কবি উদ্ধৃত চরণটি ব্যবহার করেছেন।
হেমন্তকালীন প্রকৃতির বিষাদময়তার পরিচয় রয়েছে উদ্ধৃতাংশে।
প্রকৃতি সেইসময় কুয়াশার চাদরে যেন মোড়া থাকে। রাতের আকাশে তারাদের আলোও যেন প্রাণহীন — এমনই নিষ্প্রভ থাকে। একদা আমাদের পূর্বপুরুষগণ প্রাণের আবেগে জেগে উঠতেন, পরস্পর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে হাসি-খেলায় মাততেন। বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর যেন সব কেড়ে নিয়েছে। তাই পুরোনো সব রীতিনীতি বর্তমানে মৃতের চোখের মতোই প্রাণহীন হয়ে পড়েছে — নেই সারল্য, নেই প্রেম, নেই আলোর দিশা। তবুও তো আলোর খোঁজে ছুটতেই হয়। বর্তমানে সেই আলো হেমন্তের তারার আলোর মতোই শক্তিহীন, মলিন। উদ্ধৃতাংশের মাধ্যমে কবি এ কথাই বুঝিয়েছেন।
প্রশ্ন- “চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে”—কোন বিষাদের কথা কবি বলতে চেয়েছেন?
উত্তর : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ভয়ংকর মন্বন্তরে বিপর্যস্ত হয়েছে বাংলার জনজীবন। এই সংকটকালেও বিলাসী মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের বিলাসী মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে অক্ষম। তবে বর্তমান পরিবেশে তাদের বাসনা
হয়তো-বা পরিতৃপ্ত হতে সমস্যা হতে পারে। আধুনিক যুগযন্ত্রণায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদা তো কখনোই কমেনি। অপরিসীন ভোগবাসনায় মগ্ন থাকাকেই তারা তাদের জীবনদর্শন বলে মনে করত। ভদ্র সাধারণ নিজেরাই অনুভব করেছিল সভ্যতার পঙ্কিল অবস্থাকে। এই মধ্যবিত্ত বিলাসী মনোভাবাপন্ন শ্রেণি নিজেদের লোভকে সংবরণ করতে পারে না। সাধারণ দরিদ্র শ্রেণির মানুষের দুঃখযন্ত্রণায় তাদের কোনো দায় আছে বলেও তারা মনে করে না। তাদের ভোগবাসনা সীমাহীন, তাদের এই বাসনাও অনেক ক্ষেত্রে পূরণ হবে না সাম্প্রতিক সমাজব্যবস্থায়। তাই তারা বিষাদগ্রস্থ। এই বিষাদের কথাই
কবি আলোচ্য কবিতায় বলতে চেয়েছেন।

প্রশ্ন:- "মধ্যবিত্ত মানুষের বেদনার নিরাশার হিসেব ডিঙিয়ে” কারা, কী করে বুঝিয়ে দাও।
উত্তর : প্রশ্নোকৃত অংশটি জীবনানন্দ দাশ রচিত 'তিমির হননের গান' নামক কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে 'কারা' বলতে সমাজের অর্থনৈতিকভাবে নীচুতলায় বসবাসকারী দরিদ্র সাধারণ মানুষকে বোঝানো হয়েছে। যারা বাঁচার
জন্য কঠিন সংগ্রাম করে অথচ মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঘৃণার পাত্র এরা। আধুনিক যুগযন্ত্রণায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়তে হয় সমাজে পিছিয়ে পড়া দরিদ্র শ্রেণিকে। দুর্ভিক্ষের কালো ছায়া ঘিরে ধরে তাদেরকে। লঙ্গরখানায় খাদ্যের সারিতে অপেক্ষা করতে করতে জীবনের খানিকটা সময় কেটে যায় এদের। তারা তবুও অন্ধকারের বিনাশ চায়, আলোকময় জীবনের স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে তারা। মধ্যবিত্তের হতাশা, বেদনা, নিরাশার ডিঙি পেরিয়েও টিকে থাকতে চায় এই দরিদ্র অসহায় শ্রেণির মানুষ।
প্রশ্ন :'তিমির হননের গান' কবিতায় 'এরা' ও 'ওরা' বলতে কবি কাদের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন?
উত্তর : কবি জীবনানন্দ দাশ ‘তিমির হননের গান' কবিতায় 'এরা' ও ‘ওরা’-এর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সমাজের দুই শ্রেণির মানুষের চিন্তা-চেতনা
ও পরিস্থিতির চিত্র অঙ্কন করেছেন।
‘এরা’ বলতে সভ্যতার বুনিয়াদ গঠনকারী শ্রমজীবী দরিদ্র শ্রেণিকে আর ‘ওরা’ বলতে আত্মসর্বস্ব, ভোগবাদী, বিলাসী মধ্যবিত্তকে ইঙ্গিত করেছেন কবি। সমাজের অবক্ষয়ে এই মধ্যবিত্তের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিল না, ছিল না দরিদ্রের জন্য কোনো বেদনাবোধও। এরাই আবার লঙ্গরখানায় খাদ্যের সারিতে দাঁড়িয়ে অন্ন খুঁটে খাওয়া মানুষদের ঘৃণা করে দূরে সরিয়ে রেখে, ঠেলে দেয় অন্তহীন বেদনার পথে। ‘এরা' না-খেতে পেয়ে গ্রামেগঞ্জে, নগরে-প্রান্তরে ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। অন্যদিকে ‘ওরা’ মহানগরীর মৃগনাভি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মশগুল হয়ে থাকে। সীমাহীন ভোগবাসনায় লিপ্ত থাকতে থাকতে ‘ওরা’ ভুলেই যায় সমাজটা শুধু তাদের নিয়েই নয়, সাধারণ মানুষও আছে এখানে; তাদের প্রতিও যত্নশীল হওয়া উচিত। ‘এরা' বিরামহীনভাবে জীবনসংগ্রামে লিপ্ত থাকে আর ‘ওরা’ দরিদ্রের শ্রমকে চুরি করে নিজেদের বিলাসীতায় কাজে লাগায়।

প্রশ্ন:-  ‘তিমির হননের গান' কবিতায় কবি কোন বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন ?

উত্তর : জীবনানন্দ দাশ রচিত ‘তিমির হননের গান' প্রকৃতপক্ষে অন্ধকারকে বিদূরিত করে এগিয়ে যাবার গান। বিশ্বযুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মনে শক্তি ফিরে পাওয়ার গান হল আলোচ্য কবিতাটি। দরিদ্র শ্রেণির মানুষ ক্ষুধার অন্ন পাওয়ার জন্য লঙ্গরখানায় মানুষের সারিতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আর অন্যদিকে মধ্যবিত্তমদির জগতের ‘তিমিরবিলাসী' মানসিকতা—এই দুই বিপরীত মনোভাবের মানুষের বৈশিষ্ট্য আলোচ্য কবিতায় বর্ণিত হয়েছে। কবির মতে আমরা কোনো এক সমুজ্জ্বল ভোরের প্রত্যাশায় রয়েছি। মানবতাকে রক্ষা করতে হলে আমাদের অন্ধকারের যাত্রী হলে চলবে না, আমাদের হতে হবে অন্ধকার-বিনাশী। সংশয়ের অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে রেখে আমাদের আলোর পথযাত্রী হতেই হবে। কারণ অন্ধকার তো জীবন হতে পারে না, অন্ধকার সাঁতরে আলোতে ফেরাই জীবনের লক্ষ্য। এই বার্তাই কবি আলোচা কবিতায় দিতে চেয়েছেন।

প্রশ্ন:  'তিমির হননের গান' কবিতায় কবি কীসের জয়গান করেছেন?
উত্তর : কবি জীবনানন্দ দাশের 'সাতটি তারার তিমির' কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হল 'তিমির হননের গান' কবিতাটি। 'তিমির' হল অন্ধকার, 'হনন' শব্দের অর্থ হত্যা করা, ধ্বংস বা বিনাশ করা। তাহলে তিমির হননের গান কথার অর্থ হল তিমির বা অন্ধকারের অবসান ঘটানোর গান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পঞ্চাশের মন্বন্তর বাংলার জনজীবনে ডেকে এনেছিল ভয়ংকর সংকটাবস্থা। প্রাণহানী, সম্পদহানী, মানবতার অপমান এদেশের বুকে নামিয়ে এনেছিল সীমাহীন অন্ধকার। জীবন-জীবিকায় নেমেছিল কালো যবনিকা। এই অন্ধকার থেকে মুক্তির পথের সম্মান দিতে চেয়েছেন কবি। মধ্যবিত্ত স্বপ্নমদির হয়ে বিলাসেই মগ্ন থাকতে পারে কিন্তু দরিদ্র শ্রেণির মানুষ চায় অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে রেখে আলোয় ফিরতে। তিমিরবিলাসী জীবন সাধারণের জন্য নয়, সাধারণ চায় তিমিরের অবসান ঘটিয়ে আলোর স্রোতে গা ভাসাতে। সে-কথাই কবি আলোচ্য কবিতায় বলেছেন। অর্থাৎ আলোচ্য কবিতায় কবি আলোকময় জীবনের জয়গানই রচনা করেছেন।

প্রশ্ন : “আমরা কি তিমিরবিলাসী ?”—উক্তিটির মাধ্যমে কবি কীসের ইঙ্গিত দিয়েছেন?
উত্তর : 'তিমির হননের গান' কবিতায় কবি জীবনানন্দ দাশ উদ্ধৃত প্রশ্নটি রেখেছেন বর্তমান সমাজের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পঞ্চাশের মন্বন্তর বাংলার জনজীবনে সংকট ডেকে এনেছিল। একদিকে মৃত্যুর মিছিল, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত ভেদবাদী জীবনদর্শন সভ্যতাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করেছিল, সেখান থেকে উত্তরণের দিশা দেখাতেও পারেনি বিলাসী শ্রেণির মানুষজন। মানবতার এই দুর্দশা, মধ্যবিত্তের সীমাহীন আত্মকেন্দ্রিকতায় ব্যথিত হয়েছেন কবি। তাই তমসাচ্ছন্ন অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার গান গেয়েছেন।
তিনি আলোচ্য কবিতায় দরিদ্র সাধারণ মানুষ কখনোই তিমিরকে পছন্দ করে না। তারা চায় অন্ধকারের গর্ভ থেকে মুক্তি পেয়ে আলোর অভিমুখে যাত্রা করতে। চিরন্তন যাত্রী মানুষ চলতে চলতেই অন্ধকারের উৎস থেকে আলোর ঠিকানা খুঁজে নিতে চায়। অর্থাৎ আমরা কখনোই তিমিরবিলাসী নই, আমরা ‘তিমিরবিনাশী'। প্রশ্নোত্ত উদ্ধৃতির মাধ্যমে কবি এমন ইঙ্গিতই দিয়েছেন।

প্রশ্ন:-  'তিমির হননের গান' কবিতাটি কোন্ প্রেক্ষাপটে লেখা?
কবি কেন 'তিমিরবিলাসী' নয়, ‘তিমিরবিনাশী' হতে চেয়েছেন?

উত্তর : প্রেক্ষাপট : কবি জীবনানন্দ দাশ ‘তিমির হননের গান' কবিতাটি রচনা।করেছেন ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে। অর্থাৎ বাংলার মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের পটভূমিতে রচিত হয়েছে উক্ত কবিতাটি। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলা, অন্যদিকে পঞ্চাশের প্রাণঘাতী মন্বন্তর বাংলার জনজীবনে ডেকে এনেছিল ভয়ানক সংকট। মানুষের মনে ছিল না কোনো শান্তি, ছিল না আগামীতে ভালো থাকার কোনো আশ্বাস। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষ শুধু মানুষের প্রাণকেই কেড়ে নেয়নি,।ধ্বংস করেছিল মানসিক আশা-ভরসার জায়গাগুলিকেও | একদিকে মানুষের মৃত্যুমিছিল, অন্যদিকে প্রাকৃতিক ও ব্যাবহারিক সম্পদের বিনাশ—বাংলার আকাশ তখন অন্ধকারে ঢাকা। এমনই তমসাচ্ছন্ন প্রেক্ষাপটে কবি জীবনানন্দ দাশ রচনা করেছেন 'তিমির হননের গান' কবিতাটি।
*কবির তিমিরবিলাসী' না-হয়ে ‘তিমিরবিনাশী' হতে চাওয়ার কারণ : সাহিত্য হল সমাজদর্পণ। অর্থাৎ সাহিত্যিকের রচনার মধ্যে সমাজের প্রতিবিম্ব ধরা পড়ে। সেইসঙ্গে সাহিত্যিকের মনের গভীরে জমে থাকা ভাবেরও প্রকাশ ঘটে সাহিত্যের পাতায়। সভ্যতার সংকটকে প্রত্যক্ষ করে কবিগণ কখনো নীরব থাকতে পারেন না। সমাজের নৈরাজ্য, অসাম্য, অন্ধকারের অবদান তাঁরা আকাঙ্ক্ষা করেন। আর সেই ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটান তাঁদের রচনার। কবিরা চান সমাজকে শোধন করতে। অন্ধকারের উৎস থেকে আলোর অভিমুখে যাত্রার পথনির্দেশ করেন কবিগণ। বিলাসীতাপূর্ণ গড্ডলিকা প্রবাহে তাঁরা ভাসমান নন। মধ্যবিত্তের ভোগবাদী জীবনদর্শনে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সভ্যতার বুনিয়াদ গঠন করে সাধারণ জনগণ। তাঁরা কখনোই তিমিরবিলাসী হতে পারেন না। কারণ তিমিরের নেতিবাচক প্রভাবে তাঁরাই ক্ষতিগ্রস্ত হন অধিক। চিরন্তন যাত্রী মানুষ পথ চলতে চলতেই আলোর ঠিকানা খুঁজে নেবেন বলে কবির বিশ্বাস। তিমিরের অবসান ঘটানোই তাঁদের উদ্দেশ্য। কবিও এই সত্যকেই মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন। তাই তিনি 'তিমিরবিলাসী' নন, 'তিমিরবিনাশী' হতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন: “শতাব্দীর সূর্যের নিকটে/আমাদের জীবনের আলোড়ন—” —উদ্ধৃতাংশে কবি সূর্যের প্রসঙ্গ কেন এনেছেন? জীবনের আলোড়ন বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন?

উত্তর : প্রসঙ্গ : প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত তিমির হননের গান' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকরতা।এবং পঞ্চাশের প্রাণঘাতী মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটে রচিত আলোচ্য কবিতাটি অর্থাৎ সময়টা মানব সভ্যতার পক্ষে মোটেই সুবিধের ছিল না। বাংলার সমাজ ও সভ্যতা হয়ে পড়েছিল তমসাচ্ছন্ন। সেই তমসাচ্ছন্নতাকে ছিন্ন করে সূর্যের।আলোয় বেরিয়ে আসার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কথা ধ্বনিত হয়েছে আলোচ্য চরণদ্বয়ে সূর্যালোকের অভাবে পৃথিবীতে নেমে আসে নিকষ অন্ধকার। এই অন্ধকার মানবিক চেতনাকেও স্থবিরতায় পর্যবসিত করে। অন্ধকার সাঁতরে আলোর দিকে যাত্রা করাই আমাদের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বলে মনে করেছেন কবি
জীবনানন্দ দাশ। সূর্যালোকই পারে আমাদের মনের শুভকে জাগ্রত করতে তাই কবি উদ্ধৃতাংশে সূর্যের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন।
→ ‘জীবনের আলোড়ন’–সরলার্থ : পারিপার্শ্বিক নানান ঘটনা মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, আলোড়িত করে। আজকের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন ছি না আমাদের পূর্বপুরুষদের পৃথিবী। আমাদের পূর্বপুরুষগণ পরস্পর পরস্পরের সাথে মিলেমিশে হেসে-খেলে গড়ে তুলেছিলেন সভ্যতার বুনিয়াদ। সহজসর প্রেমের সম্পর্কে কান্না-হাসিতে আলোড়িত হত তাঁদের জীবন। সহযোগিতা সহমর্মিতার মাধ্যমে তাঁরা পরস্পরকে বুঝেছেন, একটু একটু করে লিখেছেন বেঁচ থাকার কৌশল। তাঁদের জীবনকে গ্রাস করতে পারেনি বর্তমানের তুচ্ছাতিতুম সংকীর্ণ মানসিকতা। তাঁদের জীবন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ভরপুর। জীবনোর আলোড়ন' বলতে কবি এমন গতিশীল, প্রাণময় জীবনের স্পন্দনকেই বুঝিয়েছেন
প্রশ্ন- “সেই সব রীতি আজ মৃতের চোখের মতো”— কোন্ রীতির কথা কবি বলতে চেয়েছেন? তাকে মৃতের চোখের মতো মনে হয়েছে কেন ?

উত্তর : কবির বলা রীতির পরিচয় : প্রশ্নোক্ত উদ্ধৃতিটি জীবনানন্দ দাশ রচিত তিমির হননের গান' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ংকরতা এবং মন্বন্তরে বিধ্বস্ত বাংলার তমসাচ্ছন্ন প্রেক্ষাপটে কবি উক্ত কবিতাটি রচনা করেছেন। ফলে সামাজিক সংকটের ছবিটিও ধরা পড়েছে এই কবিতায়।
কবি বলতে চেয়েছেন আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়ে এই পৃথিবীর রূপ এমন স্বার্থের বিষবাষ্পে পরিপূর্ণ ছিল না। নানাপ্রকার সামাজিক রীতিনীতির মাধ্যমে মানুষের মেলবন্ধন সুদৃঢ় ছিল। মানুষ আপনার বাইরে বেরিয়েও অনেকটা বড়ো করে মানুষকে আপন করে নিতে পারত। তারা পারস্পরিক সাহচর্যে হাসি-আনন্দে মেতে উঠতে পারত। সেখানে কোনো মানসিক গ্লানি, মলিনতা ছিল না; ছিল শুদ্ধ প্রেমের বন্ধন। নির্মল আকাশের মতোই তাদের চোখের ভাষা ছিল আবিলতাহীন। জীবনকে ভালোবেসে শিখতে চেয়েছিল তারা।জলের মতো সহজভাবে মিশেছিল তারা। শুদ্ধ প্রেম, আবিলতাহীন চোখের ভাষা, জীবনকে শিখতে চাওয়া—এই সব রীতির কথাই কবি বলতে চেয়েছেন।
** মৃতের চোখের মতো কেন: কবির মতে পূর্বের সহজসরল জলের
মিশে গিয়ে অন্তরের আকর্ষণ অনুভব করা তথা শুদ্ধ প্রেম আজ আর নেই। যুদ্ধ, মন্বন্তর কেড়ে নিয়েছে মানুষের মনের শান্তি। মধ্যবিত্তমদির শ্রেণি
বিলাসীতায় নিমগ্ন। সাধারণের প্রতি তাদের রয়েছে শুধুই ঘৃণা। মৃত মানুষের চোখ ঘোলাটে বা ফ্যাকাসে হয়। বোঝাই যায় তা প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। আধুনিক ভোগবাদী সমাজে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কও যেন এমনই প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। মানবিক সম্পর্কের এমন শুষ্কতা, প্রাণহীনতার কারণেই পূর্বের প্রচলিত রীতিগুলিকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে মৃতের চোখের মতো মনে হয়েছে কবির।

প্রশ্ন:- “সূর্যালোক নেই—তবু—/সূর্যালোক মনোরম মনে হ'লে হাসি।”-কোন্ প্রসঙ্গে কবি উক্তিটি করেছেন? উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর : প্রসঙ্গা : প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত ‘তিমির হননের গান' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর বাংলার বুকে নামিয়ে এনেছিল ভয়ানক সংকটকালীন পরিস্থিতি। মানবসভ্যতায় নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা। কোথাও যেন কোনো আলোর সন্ধান নেই।
তবে আমজনতাকে তো প্রাণের দীপশিখা জ্বালিয়ে রাখতেই হবে, অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসে মুক্ত আলোর সন্ধান করতে হবে। সূর্যালোকের প্রত্যাশায় মনের হাসিটুকুকে বাঁচিত্রে রাখা প্রয়োজন— এই প্রসঙ্গেই কবি উক্তিটি করেছেন।
তাৎপর্য : জীবনের আলোর দিক, উজ্জ্বল্যের দিক, আশার দিককে সূচিত করে আলো। রাতের অবসানে সূর্যের আলো নতুন দিনকে চিহ্নিত করে।
আলো জীবনে বয়ে আনে সুখ, প্রশান্তি। অন্ধকার বিদূরিত হয়ে সূর্যালোক প্রকাশিত হলেই আমাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কারণ অন্ধকার কেউ চায় না। সকালের কোমল আলোর সৌন্দর্যে পুলকিত হয় মানবহৃদয়। অন্ধকার হল জীবনের নেতিবাচক দিক, আলো ইতিবাচক দিক আমাদের আকাঙ্ক্ষা থাকে নেতিবাচকতা কাটিয়ে উঠে ইতিবাচকতার দিকে এগিয়ে যাওয়া। উদ্ধৃতাংশের দ্বিতীয় চরণটি আনন্দময় জীবনের প্রত্যাশাকে বাড়িয়ে দেয়। অন্ধকার কখনোই জীবনের লক্ষ্য নয়, হাসি-আনন্দে মিলেমিশে একত্রে সমব্যথী-সহমর্মী হয়ে বেঁচে থাকাটাই জীবনের লক্ষ্য। এইভাবে বাঁচাই সূর্যের মনোরম আলোর
মতোই জীবনকেও আলোকময় করে তুলতে পারে।

প্রশ্ন; “স্বতই বিমর্ষ হ'য়ে ভদ্র সাধারণ/চেয়ে দ্যাখে তবু সেই বিষাদের চেয়ে”—“ভদ্র সাধারণ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে? কবি এখানে কোন্ বিষাদের কথা বলতে চেয়েছেন?    উত্তর : 'ভদ্র সাধারণ'-এর পরিচয় : প্রশ্নোক্ত অংশটি জীবনানন্দ দাশ রচিত 'তিমির হননের গান' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। আলোচ্যমান অংশে ভিদ্র সাধারণ'-এর কথা কবি উল্লেখ করেছেন। সাধারণ অর্থে 'ভদ্র সাধারণ' বলতে শিক্ষিত, মার্জিত রুচিসম্পন্ন, সংবেদনশীল মানুষকে বোঝায়, যাঁরা সমাজের রীতিনীতি ও নৈতিকতা সম্পর্কে ভীষণভাবে সচেতন। এঁরা স্বাভাবিকভাবেই বিবেকবানও হন। তবে আলোচ্য কবিতায় কবি মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষগণকে ইঙ্গিত করেছেন, যাদের পুর্বোক্ত বৈশিষ্ট্যগুলির অনেকগুলি বর্তমান থাকলেও মধ্যবিত্তমদিরতায় তারা আক্রান্ত হয়ে বিলাসী, আত্মস্বার্থ সর্বস্ব। দরিদ্র সাধারণের প্রতি তাদের আচরণ অমানবিক। এমন শ্রেণিকেই কবি আলোচ্য কবিতায় 'ভদ্র সাধারণ' বলে বিদ্রুপ করেছেন।
• কবির ব্যক্ত বিষাদের কথা : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং পঞ্চাশের মন্বন্তরে বিপর্যস্ত হয়েছে বাংলার জনজীবন। এই সংকটকালেও বিলাসী মধ্যবিত্ত শ্রেণি নিজেদের বিলাসী মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। আধুনিক যুগযন্ত্রণায় তাদের বাসনা হয়তো-বা পরিতৃপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তবুও নিজেদের আকাঙ্ক্ষা মেটাবার আপ্রাণ চেষ্টায় তারা মগ্ন। অপরিসীম ভোগবাসনা চরিতার্থ করাকেই এই মধ্যবিত্ত ভদ্রসমাজ জীবনদর্শন বলে মনে করে। ‘ভদ্র সাধারণ অনুভব করতে পেরেছিল সভ্যতার পঙ্কিল অবস্থাকে, কিন্তু তারা তাদের লোভকে সংবরণ করতে পারেনি। বিলাসীতা তাদের রক্তে গভীরভাবে প্রথিত হয়ে আছে। সাধারণ দরিদ্র শ্রেণির মানুষের দুঃখযন্ত্রণায় তাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। তাদের সীমাহীন ভোগবাসনা বর্তমান পটভূমিতে পূর্ণ হবে না—এমনটা অনুমান করেই তারা বিমর্ষ। সমাজের অবক্ষয় বুঝতে পেরেও তারা প্রতিবাদী নয়, পরিবর্তনের চেষ্টা নেই তাদের মধ্যে, এতটাই আত্মকেন্দ্রিকতা তাদের গ্রাস করেছে। সমাজের বড়ো অংশ থেকে তারা বিচ্ছিন্ন, তাই অনেকটাই নিঃসঙ্গ। ফলে হতাশাগ্রস্তও তারা। এই কারণেও তারা বিমর্ষ তথা বিষাদগ্রস্ত। পূর্বোক্ত বিষাদের কথাই কবি আলোচ্যমান কবিতায় ব্যাক্ত করেছেন।
প্রশ্ন: “আমরা বেদনাহীন—অন্তহীন বেদনার পথে।”—উদ্ধৃত অংশটির তাৎপর্য আলোচনা করে বুঝিয়ে দাও।
উত্তর : প্রসঙ্গ : প্রশ্নে উদ্ধৃত অংশটি জীবনানন্দ দাশ রচিত ‘তিমির হননের গান' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও পঞ্চাশের মন্বন্তর বাংলার জনজীবনকে বিধ্বস্ত করেছিল। মধ্যবিত্ত শ্রেণি তখনও তাদের বিলাসী জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। অথচ দরিদ্র শ্রেণির দুঃখের অন্ত ছিল না। মধ্যবিত্তের চাওয়া-পাওয়ার অন্ত নেই, তাই তাদেরও বেদনার অন্ত নেই।।সেই প্রসঙ্গেই উদ্ধৃত চরণটির অবতারণা।
* তাৎপর্য : মানুষকে অনেক সময় বাইরে থেকে বোঝা যায় না। বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে মানুষ অনুভূতিহীন বা বেদনাহীন। বর্তমান
পরিবেশ-পরিস্থিতিতে তাদের মনোজগতে কোনো আলোড়ন সৃষ্টি করে না। বাস্তবে তা এতটা সরল নয়। মানুষের জীবনে সুখের পাশাপাশি দুঃখ আসতেও বাধ্য, কারণ সুখ-দুঃখ পাশাপাশি অবস্থান করে। বেদনাকে উপেক্ষা করে কেউই সামনে এগিয়ে যেতে পারবে না। তাই অন্তহীনভাবে মানুষকে পথ চলতেই হয় বেদনাকে সঙ্গে নিয়েই। মানুষ অনেক সময় অনুভবই করতে পারে না যে, সে বেদনাকে সঙ্গে নিয়েই অনাগত আগামীর দিকে এগিয়ে যায় অবচেতনেই। বর্তমান সময় অতিআধুনিকতায় বিশ্বাসী, তবে এই আধুনিকতার প্রকাশ বিলাসীতায় আত্মমগ্ন। সুস্থ চেতনা বা আবেগের
প্রকাশও যেন বর্তমানের প্রেক্ষাপটে অবদমিত। অনেকে আবার একে মানসিক দুর্বলতা বলেই ভাবেন। তাঁরা বোঝাতে চান যে, তাঁরা বেদনাহীন, তাঁদের নেই কোনো দুঃখ-কষ্ট। এমন ধারণা প্রকৃতপক্ষে সঠিক নয়, বরং অন্তহীন দুঃখের পথেই আমাদের যাত্রা। সভ্যতার সংকট আমাদের মানসিকতাকে স্থবির করে দিয়েছে। মানুষের মনের মাঝে জমে উঠেছে একাকিত্ব বা শূন্যতা, যা মানুষকে ক্লান্ত করে তোলে। এই ক্লান্তি, দুঃখ-বেদনাকে সঙ্গে নিয়েই অন্তহীন যাত্রায়
বেরোতে হয়। প্রশ্নের উদ্ধৃতিটির মাধ্যমে কবি এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন : "জীবিত বা মৃত রমণীর মতো ভেবে — অন্ধকারে -মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে, উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য আলোচনা করো।

উত্তর : প্রসঙ্গ : প্রশ্নোক্ত অংশটি জীবনানন্দ দাশ রচিত তিমির হননের গান' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। হরিণের নাভি থেকে নিঃসৃত হয় এক
সুগন্ধি। মূলত পুরুষ হরিণের নাভির কাছে অবস্থিত এক বিশেষ প্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় এই সৌগন্ধ। আলোচ্যমান কবিতায় 'মৃগনাভি' শব্দের মাধ্যমে কবি বোঝাতে চেয়েছেন- যা আমিষাশী প্রাণকে বয়ে আনে। আধুনিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি সমাজের সংকটেও বেদনাহীন। কারণ নিজেদের বিলাসী জীবন নিয়েই তারা ব্যস্ত। নাগরিক জীবনের এমন অপরিসীম ভোগবাসনা প্রসঙ্গেই কবি ‘মৃগনাভি' শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
** তাৎপর্য : কবির চেতনায় মহানগরী হয়ে উঠেছে রহস্যময়ী এক রমণী। হতে পারে তিনি জীবিত, আবার হতে পারে তিনি মৃত। যেন আলো-আঁধারিতে ঘেরা এক চরিত্র এই মহানগরী, যাকে কবি ভালোবাসেন, যার জন্য কবি আন্তরিক আকর্ষণ অনুভব করেন। মহানগরীর দ্বিবিধ রূপ উপলব্ধি করেছেন কবি। কখনও তা কলকাকলীপূর্ণ, সবুজ প্রাণের মতোই সে প্রাণবন্ত, আবার কখনও তা ক্লান্ত-বিষয় অন্ধকারে নিমগ্ন—তখনই তাকে মৃত রমণী বলে মনে করেছেন কবি। আসলে আলো-কালোর দ্বন্দ্বে দ্বিধান্বিত হয়েছে কবিচেতনাও। তাই মৃগনাভি অর্থাৎ সুগন্ধির খোঁজ করেছেন তিনি। এখানে মধ্যবিত্তমদিরতাই কাজ করেছে কবির হৃদয়ে। সুগন্ধির খোঁজে হরিণ ছুটে বেড়ায় অথচ তারই নাভির কাছ থেকে নিঃসৃত হয় এই সৌগন্ধ। অর্থাৎ বিলাসী মনোভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি অসীমকে ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষাতে মশগুল হয়ে থাকে অথচ নিজের গণ্ডিকে তারা বোকে না। অন্ধকার শব্দটিকে কবি ব্যবহার করেছেন মহানগরীর রহস্যময়তাকে বোঝাতে। মৃগনাভি যেন অধরা বস্তু, তাকে ধরার জন্য লুব্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। শহরের বিষণ্ণতা, একাকিত্ব আবিষ্ট করে কবির চেতনাকে, যা উদ্ধৃত অংশে বর্ণিত হয়েছে। মহানগরী প্রাণময় সত্তা হয়ে উঠে কবিচিত্তকে মগ্ন করেছে তাতে নিমগ্ন হতে।
প্রশ্ন : তিমির হননের গান' কবিতায় কবি একাধিকবার তবু শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন কেন, আলোচনা করে বুঝিয়ে দাও
উত্তর : কবি জীবনানন্দ দাশ 'তিমির হননের গান' কবিতায় ‘তবু' শব্দট ছয়বার ব্যবহার করেছেন। তবু' অব্যয়টি সাধারণভাবে পূর্বের কোনো ঘটনার সাপেক্ষে ব্যবহার করা হয়। কবি আলোচ্য কবিতায় বিভিন্ন আঙ্গিকে 'তবু শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অন্ধকার, শোষণ, ব্যর্থতা, বিষণ্ণতা, মৃত্যুর আসন্নতাকে অতিক্রম করেও আলোর সন্ধানে ছুটে যেতে হয় মানুষকে। অনেক কিছু না-
পেলেও, অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও নতুন কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ব্যর্থতা আর গ্লানি মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়-এর পরেও মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে জগৎকে নতুন করে পাওয়ার। এখানেই ‘তবু' শব্দটির ব্যবহার তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে।
আলোচ্য 'তিমির হননের গান' কবিতার আলোকে বলা যায়—আমাদের পূর্বপুরুষদের পালিত রীতিনীতি বর্তমানে "মৃতের চোখের মতো” প্রাণহীন; ‘তবু’ আলোর দিকে চেয়ে থাকা, অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন দিগন্ত; ‘সূর্যলোক নেই'; ‘তবু’
পথেই আমাদের যাত্রা। সভ্যতার সংকট আমাদের মানসিকতাকে স্থবির করে দিয়েছে। মানুষের মনের মাঝে জমে উঠেছে একাকিত্ব বা শূন্যতা, যা মানুষকে ক্লান্ত করে তোলে। এই ক্লান্তি, দুঃখ-বেদনাকে সঙ্গে নিয়েই অন্তহীন যাত্রায়
বেরোতে হয়। প্রশ্নের উদ্ধৃতিটির মাধ্যমে কবি এ কথাই বোঝাতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন:  "জীবিত বা মৃত রমণীর মতো ভেবে — অন্ধকারে -মহানগরীর মৃগনাভি ভালোবাসি – প্রসঙ্গ উল্লেখ করে, উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য আলোচনা করো।

উত্তর : প্রসঙ্গ : প্রশ্নোক্ত অংশটি জীবনানন্দ দাশ রচিত তিমির হননের গান' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। হরিণের নাভি থেকে নিঃসৃত হয় এক
সুগন্ধি। মূলত পুরুষ হরিণের নাভির কাছে অবস্থিত এক বিশেষ প্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় এই সৌগন্ধ। আলোচ্যমান কবিতায় 'মৃগনাভি' শব্দের মাধ্যমে কবি বোঝাতে চেয়েছেন- যা আমিষাশী প্রাণকে বয়ে আনে। আধুনিক মধ্যবিত্ত
শ্রেণি সমাজের সংকটেও বেদনাহীন। কারণ নিজেদের বিলাসী জীবন নিয়েই তারা ব্যস্ত। নাগরিক জীবনের এমন অপরিসীম ভোগবাসনা প্রসঙ্গেই কবি।‘মৃগনাভি' শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
** তাৎপর্য : কবির চেতনায় মহানগরী হয়ে উঠেছে রহস্যময়ী এক রমণী। হতে পারে তিনি জীবিত, আবার হতে পারে তিনি মৃত। যেন আলো-আঁধারিতে ঘেরা এক চরিত্র এই মহানগরী, যাকে কবি ভালোবাসেন, যার জন্য কবি আন্তরিক আকর্ষণ অনুভব করেন। মহানগরীর দ্বিবিধ রূপ উপলব্ধি করেছেন কবি। কখনও তা
কলকাকলীপূর্ণ, সবুজ প্রাণের মতোই সে প্রাণবন্ত, আবার কখনও তা ক্লান্ত-বিষয় অন্ধকারে নিমগ্ন—তখনই তাকে মৃত রমণী বলে মনে করেছেন কবি। আসলে আলো-কালোর দ্বন্দ্বে দ্বিধান্বিত হয়েছে কবিচেতনাও। তাই মৃগনাভি অর্থাৎ সুগন্ধির খোঁজ করেছেন তিনি। এখানে মধ্যবিত্তমদিরতাই কাজ করেছে কবির হৃদয়ে। সুগন্ধির খোঁজে হরিণ ছুটে বেড়ায় অথচ তারই নাভির কাছ থেকে নিঃসৃত হয় এই সৌগন্ধ। অর্থাৎ বিলাসী মনোভাবাপন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি অসীমকে ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষাতে মশগুল হয়ে থাকে অথচ নিজের গণ্ডিকে তারা বোকে না। অন্ধকার শব্দটিকে কবি ব্যবহার করেছেন মহানগরীর রহস্যময়তাকে বোঝাতে। মৃগনাভি যেন অধরা বস্তু, তাকে ধরার জন্য লুব্ধ মধ্যবিত্ত শ্রেণি। শহরের বিষণ্ণতা,
একাকিত্ব আবিষ্ট করে কবির চেতনাকে, যা উদ্ধৃত অংশে বর্ণিত হয়েছে। মহানগরী প্রাণময় সত্তা হয়ে উঠে কবিচিত্তকে মগ্ন করেছে তাতে নিমগ্ন হতে।
প্রশ্ন : তিমির হননের গান' কবিতায় কবি একাধিকবার তবু শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন কেন, আলোচনা করে বুঝিয়ে দাও।
উত্তর : কবি জীবনানন্দ দাশ 'তিমির হননের গান' কবিতায় ‘তবু' শব্দটি ছয়বার ব্যবহার করেছেন। তবু' অব্যয়টি সাধারণভাবে পূর্বের কোনো ঘটনার সাপেক্ষে ব্যবহার করা হয়। কবি আলোচ্য কবিতায় বিভিন্ন আঙ্গিকে 'তবু শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অন্ধকার, শোষণ, ব্যর্থতা, বিষণ্ণতা, মৃত্যুর আসন্নতাকে অতিক্রম করেও আলোর সন্ধানে ছুটে যেতে হয় মানুষকে। অনেক কিছু না-
পেলেও, অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও নতুন কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ব্যর্থতা আর গ্লানি মানেই সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়-এর পরেও মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে জগৎকে নতুন করে পাওয়ার। এখানেই ‘তবু' শব্দটির ব্যবহার তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। আলোচ্য 'তিমির হননের গান' কবিতার আলোকে বলা যায়—আমাদের পূর্বপুরুষদের পালিত রীতিনীতি বর্তমানে "মৃতের চোখের মতো” প্রাণহীন; ‘তবু’ আলোর দিকে চেয়ে থাকা, অন্ধকারে সমাচ্ছন্ন দিগন্ত; ‘সূর্যলোক নেই'; ‘তবু’ মনোরম সূর্যালোকের প্রতীক্ষাতেই হৃদয়ের হাসিটুকুকে বাঁচিয়ে রাখা, ভদ্র সাধারণ ‘স্বতই বিমর্ষ’; তাদেরই সৃষ্টি করা বর্তমান পৃথিবীর সংকটবস্থাকে উপলব্ধি করে; ‘তবু’ সেই বিষাদের থেকেও অধিক বিষাদময় অন্ধকারে আচ্ছন্ন অন্নহীন বাসস্থান হারা দরিদ্রদের জীবন। দরিদ্ররা সংগ্রাম করে টিকে থাকার জন্য। ‘এরা সব এই পথে’ অথবা 'ওরা সব ওই পথে’এই 'এরা' আর 'ওরা'য়
দ্বিধাবিভক্ত সমাজ। ‘তবু’মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোনো হুঁশ নেই। বেদনা আছে জেনেও অন্তহীন বেদনার পথেই তাদের যাত্রা। চারিদিকে নৈরাশ্য, নিঃসঙ্গতা; 'তরু' আমরা আলোর খোঁজ করি, বেঁচে থাকার প্রাণপণ প্রয়াসে মগ্ন রাখি নিজেদের।
মহানগরীর রহস্যময়তায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে মধ্যবিত্তরা, যেন মৃগনাভি পাওয়ার মত্ততায় নিমগ্ন চেতনা তাদের। তাই তারা হয়ে পড়েন তিমিরবিলাসী। 'তবু' সাধারণের চেতনা সমাজের বুক থেকে তিমিরকে দূরে সরাতে চায়। কারণ চলমান মানুষ কখনোই তিমিরবিলাসী নয়, তিমিরবিনাশী হতে চায়। এই তিমিরকে ছিন্ন করে আলোচ্য কবিতায় বারবার 'তরু' শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
প্রশ্ন:- 'তিমির হননের গান' কবিতার মাধ্যমে কবি সমাজকে কোন্ বার্তা দিতে চেয়েছেন? এখানে কবিসত্তার প্রকাশ ঘটেছে কীভাবে লেখো।

উত্তর : কবিতায় সমাজকে দেওয়া কবির বার্তা : কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত।‘সাতটি তারার তিমির" কাব্যের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য কবিতা হল 'তিমির হননের গান' কবিতাটি। তিমির' অর্থাৎ অন্ধকার, এই অন্ধকার বলতে কবি সামাজিক বা রাজনৈতিক অসাম্য, নিষ্ঠুরতা, চেতনার অবক্ষয়, মানবিক মূল্যবোধের পতনজনিত অন্ধকারকে বুঝিয়েছেন; যা আমাদের ঘিরে রেখেছে আষ্টেপৃষ্টে, এর থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হয়ে পড়েছে। এই তিমিরকে ধ্বংস তথা নাশ করাই হল তিমির হনন' কথার অর্থ। বিশ্বযুদ্ধ ও মন্বন্তরের সমকালে প্রাণহানী, সম্পদহানী, মানবতার অপমানে এদেশের বুকে নেমে এসেছিল সীমাহীন অন্ধকার। মানুষের জীবন-জীবিকায় নেমে এসেছিল কালো
যবনিকা। মধ্যবিত্ত শ্রেণি আপ্লুত হয়ে ছিল স্বপমদিরতায়। এমন পরিস্থিতি তো দরিদ্র সাধারণ চায় না, তেমনই চান না মানবতাবাদী কবিও। কবি চান অন্ধকার দূর করে আলোকে আহ্বান জানাতে। তিমিরবিলাসী জীবন তো দরিদ্রদের জন্য নয়, তিমিরকে নাশ করে আলোর স্রোতে গা ভাসাতে চায় তারা। চিরন্তন যাত্রী মানুষ চলতে চলতেই অন্ধকারের উৎস থেকে আলোর ঠিকানা খুঁজে নিতে চারা। কারণ আমরা তিমিরবিনাশী'। কবি সমাজকে এই বার্তাই পৌঁছে দিতে চেয়েছেন।
* কবিসত্তার প্রকাশ : মানুষের অন্তর্বণাকে ছোটো ছোটো বাক্যে তুলে ধরতে পারেন আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ। আবার সেই বাক্যগুলি ইচ্ছাশক্তির জন্ম দেয়। সেই ইচ্ছাশক্তির জোরে জীবন উপস্থিত হতে পারে সময়ের রাজপথে।
সেই রাজপথ অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যৎ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। আর সেই রাজপথের যাত্রীগণ কখনোই নিশ্চিতে দিনযাপন করবেন না, হতে পারবেন না তিমিরবিলাসী। অন্ধকারকে মেনে নেবেন না তাঁরা। অন্ধকার সাঁতরে আলোর উৎসের দিকেই যাত্রা করবেন তাঁরা, কারণ তাঁরা তিমিরবিনাশী। আলোচ্য 'তিমির হননের গান' কবিতায় এই সত্য প্রকাশের মাধ্যমে কবিসত্তার
সংগ্রামী, মানবদরদী, নৈরাশ্য কাটিয়ে আশাবাদের দিকগুলিই প্রকট হয়ে উঠেছে। আলোর প্রত্যাশী ও জীবনমুখী কবিসত্তার প্রকাশ ঘটেছে এখানে।
প্রশ্ন :  'তিমির হননের গান কবিতাটির নামকরণের সার্থকতা আলোচনা করো।
উত্তর : উত্তরের জন্য ‘নামকরণ' অংশটি দ্রষ্টব্য।