নানা রঙের দিন নাট্যাংশের কিছু প্রশ্নের উত্তর। দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা।
![]() |
নানা রঙের দিন
নাট্যাংশ
দ্বাদশ শ্রেণী বাংলা।
নানা রঙের দিন নাট্যাংশের বিষয়সংক্ষেপ
পেশাদারি থিয়েটারের ফাঁকা অন্ধকার মঞ্জু। এসময় একটা জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে দিলদারের চরিত্রাভিনেতা বৃদ্ধ রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রবেশ
করেন। তিনি নাটক শেষে অতিরিক্ত মদ খেয়ে গ্রিনরুমেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। আচমকা ঘুম ভাঙায় তিনি রাত কত ঠাহর করতে পারেন না। বাড়ি ফেরার কথা ভেবে উচ্চস্বরে রামব্রীজকে ডাকেন। কিন্তু নিঝুম অন্ধকার থিয়েটারে; তাঁর গলার আওয়াজই ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসে। মাঝরাত্তিরে ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে একলা দাঁড়িয়ে কেমন একটা ভয়-আতঙ্ক ঘিরে ধরে তাঁকে।
এই আটষট্টিটা বছর এক-পা এক পা করে এগিয়ে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছেন। জীবনে প্রথম গভীর অন্ধকারে ডুবে থাকা এ প্রেক্ষাগৃহকে যেন রজনীকান্তের শ্মশান বলে মনে হয়। তার দেয়ালে কালো অঙ্গারে জীবনের শেষ কথাগুলি লেখা হয়ে আছে। অস্থির, ভীত, বেসামাল রজনীকান্ত উইংস দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করলে ময়লা পাজামা ও কালো চাদর গায়ে এলোমেলো চুলের আর-এক বৃদ্ধ এসে ঢোকেন। তিনি প্রম্পটার কালীনাথ সেন। কোথাও শোওয়ার জায়গা না-থাকায় বৃদ্ধ কালীনাথ রোজ লুকিয়ে গ্রিনরুমে ঘুমোন।
কালীনাথকে চিনতে পেরে রজনীকান্ত সংবিত ফিরে পান। তাঁর অতীতচারী মন অভিনেতা জীবনের অনিবার্য
কেন এলো না গল্পের প্রশ্নের উত্তর দেখুন
নিয়তির কথা তুলে ধরে। অভিনেতার কদর একমাত্র মঞ্চে। কিন্তু অভিনয় শেষ হলে সেই নিঃসঙ্গ মানুষটির খবর আর কেউ রাখে না। সুদীর্ঘ অভিনয় জীবনের প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হয় স্ত্রী-ছেলেমেয়ে-ঘর-সংসার এসব কিছুই তাঁর নেই। তিনি সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ, একলা। শিল্পীর একাকিত্বের এই দুঃসহ যন্ত্রণা তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। যদিও তাঁর জীবনে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির খতিয়ান কিছু কম নয়। তিনি দর্শকের ভালোবাসা পেয়েছেন। কিন্তু সেই ভালোবাসা পেয়েছেন তো আসলে অভিনেতা রজনীকান্ত: ব্যক্তি রজনীকান্তর কথা কখনও দর্শক ভেবেছে কি? রক্তমাংসের রজনীকান্তর কথা? যার জন্ম হয়েছিল রাঢ় বাংলার এক প্রাচীন
ভদ্র ব্রাক্ষ্মণ বংশে; যে নাটককে ভালোবেসে পুলিশের চাকরি ছেড়েছিল; এমনকি থিয়েটারের প্রতি সীমাহীন ভালোবাসার কারণে প্রেমিকার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ ঘটেছিল যাঁর। আজ তাই অভিনেতা জীবন সায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়ে তাঁর মনে হয়, নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প'-এর চেয়ে বড়ো মিথ্যে কথা ছাড়া আর কিছুই নেই। সত্যি কথাটা হল, অভিনেতা হল একটা চাকর বা জোকার কিংবা ক্লাউন, যার একমাত্র কাজ দর্শকের বিনোদন। এক্ষেত্রে একজন ভাঁড় বা মোসায়েবের সঙ্গে অভিনেতার কোনো তফাত নেই। দর্শকের হাততালি, সংবাদপত্রের প্রশংসা, মেডেল, সার্টিফিকেট—এসব কিছুকেই তাঁর অসার ও তাৎপর্যহীন বলে মনে হয়। কারণ যে-সমস্ত জ্ঞানী মানুষ দেশের তরুণ প্রজন্ম
গোল্লায় যাচ্ছে বলে থিয়েটারওয়ালাদের গালি দেন, তাঁরাই আবার নাটকে অভিনেতার অভিনয় দেখে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। কী তাৎক্ষণিক, কী ঠুনকো একজন অভিনেতার সামাজিক সম্মান। আর এভাবেই বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন অভিনেতা ক্রমশ ফুরিয়ে আসতে থাকে। তার গলার কাজ নষ্ট হয়। চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা কমে আসে। এমন সময় কারও অদৃশ্য হাত থিয়েটারের দেয়ালে জ্বলন্ত অক্ষরে লিখে দিয়ে যায় প্রাক্তন অভিনেতা রজনী চাটুজ্জের, প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ। আজকের রাতের এই করুণ নিঝুম অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ফেলে আসা জীবনের
আটষট্টিটা বছর তাঁকে সমাগত মৃত্যুর আগুনে ঝলসে দিয়ে এই সত্যই জানিয়ে দিয়ে যায়। এসময় কালীনাথ অসহায়-অস্থির রজনীকান্তকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। তিনি আরও স্মৃতিতাড়িত হয়ে পড়েন। ফিরে যান ফেলে আসা অভিনয় জীবনের উজ্জ্বল দিনগুলিতে। কখনও রিজিয়া' নাটকের বক্তিয়ার, আবার কখনও ‘সাজাহান' নাটকের ঔরঙ্গজীবের চরিত্রের মধ্যে ডুব দেন। মুহূর্তে আটষট্টি বছরের শোক তাঁর মন থেকে উধাও হয়ে যায়। তিনি টের পান প্রতিভা চিরস্থায়ী। তাঁর রক্তের মধ্যে বহমান প্রতিভার কোনো ক্ষয়-লয় কিংবা বিনাশ নেই। কালীনাথকে কাঁদতে দেখে তিনি বলে ওঠেন; শিল্পকে যে মানুষ ভালোবেসেছে তার বার্ধক্য, একাকিত্ব, রোগ-এসব কিছুই নেই। সে মৃত্যুভয়েরও পরোয়া করে না। এবার বৃদ্ধ রজনীকান্তেরও চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে। তিনি যেন ফের যৌবন-শক্তি ও প্রতিভার বিদায়ধ্বনি শুনতে পান। এক অব্যক্ত যন্ত্রণায়, আক্ষেপ ও নৈরাশ্যে শেকসপিয়রের 'ম্যাকবেথ' থেকে বলে ওঠেন, “Life's but a walking shadow, a poor player./
That struts and frets his hour upon the stage, /And then is heard no more, "
নানা রঙের দিন নাট্য নাট্যাংশে নামকরণ সার্থকতা আলোচনা করো:
সাহিত্যের নামকরণ সাধারণত তিন প্রকারের হয়— চরিত্রকেন্দ্রিক, ঘটনাকেন্দ্রিক ও ব্যঞ্জনাধর্মী। সাহিত্যের যে-কোনো সংরূপেই নামকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখন আলোচ্য অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' নাটকের নামকরণ কোন প্রকারভুক্ত এবং তা কতদূর সার্থক ও সংগত।
এক বৃদ্ধ অভিনেতার আত্ম-উন্মোচনের ভাষ্য হল পাঠ্য একাঙ্ক নাটক ‘নানা রঙের দিন’। এই নাটকের নায়ক বৃদ্ধ নট রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তিনি একদিন অভিনয় শেষে অতিরিক্ত মদ্যপান করে বেসামাল হয়ে প্রেক্ষাগৃহের গ্রিনরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। পরে গভীর রাতে ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে একলা নিজেকে আবিষ্কার করেন দিলদারের পোশাকে। সুদীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবনে এই প্রথম মধ্যরাতে মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গ রজনীকান্তের মনে হয়; তিনি যেন মৃত্যুর মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছেন। জনমানবহীন দুপুরের জ্বলন্ত মাঠের বাতাসের মতো মনে হয় নিজেকে। সঙ্গীসাথি-আত্মীয় পরিজনহীন, সম্পূর্ণ একা। অথচ একদিন তাঁর জীবনে খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও খাতির সবই ছিল। থিয়েটারকে ভালোবেসে চাকরি ছেড়েছেন। নাটকের প্রতি অবিচ্ছেদ্য টানে প্রেমিকাকে বিসর্জন দিয়েছেন। কিন্তু জীবনের আটষট্টিটা বছর পার করে আজ মনে হয়, যারা বলে ‘নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প', তারা মিথ্যা কথা বলে। আসলে অভিনেতা একটা চাকর বা ক্লাউন ছাড়া আর কিছুই নয়। সে ভাঁড়ের মতো দর্শকের মনোরঞ্জন করে মাত্র। এই একাকিত্ব, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারার অক্ষমতা, পরিত্যক্ত ও স্বীকৃতিহীন অভিনেতার জীবন তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। অথচ একদিন ‘সাজাহান’ নাটকের ঔরঙ্গজীব কিংবা ‘রিজিয়ার’ বক্তিয়ার চরিত্রকে কেমন নতুন রঙে ভরিয়ে তুলেছিলেন তিনি। এ জন্যেই তিনি উপলব্ধি করেন শিল্পীর বার্ধক্য, একাকিত্ব কিংবা মৃত্যুভয় নেই। কারণ প্রতিভার মৃত্যু হয় না। অথচ শুধু অভিনয়-প্রতিভা দিয়ে তো আর বুড়ো রজনী চাটুজ্জের বর্তমান জীবনের শূন্য পাত্রকে পূর্ণ করা যায় না। এভাবেই আশা, আক্ষেপ, প্রাপ্তি, অপ্রাপ্তি, বিশ্বাস ও নৈরাশ্যের টানাপোড়েনে এক অভিনেতার জীবনের বর্ণময় অতীতের সঙ্গে আজকের বর্ণহীনতার বহুমাত্রিক সমন্বয়ে, 'নানা
রঙের দিন'-এর ব্যঞ্জনাবাহী নামকরণ হয়ে ওঠে নামকরণটি সার্থক হয়েছে বলে আমার মনে হয়।
রচনাধর্মী প্রশ্নোত্তর
প্রশ্ন: “আচ্ছা পাগলের পাল্লায় পড়া গেছে”–‘পাগল’-এর পরিচয় দাও। তার ‘পাল্লায় পড়া' বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
উত্তর; পাগল-এর পরিচয় : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন’ নাটক। একে গৃহীত উদ্ধৃতাংশে ‘পাগল' বলতে থিয়েটারের কর্মী রামব্রিজের কথা বলা হয়েছে। রজনীকান্তের সঙ্গে তার সম্পর্ক ভালো। হতাশার যন্ত্রণায় রজনী যখন মদ খেয়ে গ্রিনরুমে পড়ে থাকেন, রামব্রিজ-ই তাঁকে ঘুম থেকে তুলে ট্যাক্সি ডেকে বাড়ি পাঠান। তার এই পরোপকারিতার জন্য রজনী তাকে
তিন টাকা বকশিশ দিলে সেই টাকায় মদ কিনে দুজনে খেয়েছে। আজ শূন্য প্রেক্ষাগৃহে রামব্রিজকে ডেকে সাড়া না-পাওয়ায় তাকে 'পাগল' বলে সম্বোধন করেছেন রজনী।
'পাল্লার পড়া' : 'নানা রঙের দিন' নাটকে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে ফাঁকা মরে দিলদারের পোশাকে এসে উপস্থিত হতে দেখা যায়। তিনি অভিনর শেষে অতিরিক্ত মদ্যপান করে গ্রিনরুমে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। মধ্যরাতে নির্জন প্রেক্ষাগৃহে অসংলগ্ন অবস্থায় রজনীকান্তের ভয় করতে শুরু করে। তিনি নিরুপায় হয়ে চিৎকার করে রামব্রিজকে ডাকতে থাকেন। কিন্তু নিঝুম থিয়েটার হলে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে কেবল তাঁর গলার স্বরই ঘুরে ফিরে ভেসে আসে। গত রাতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটেছিল।
তখন মাঝরাতে রামব্রিজই তাঁকে ঘুম থেকে তুলে ট্যাক্সিতে চাপিয়ে দিয়েছিল।
এমন উপকারের জন্য কৃতজ্ঞতাবশে আজ সন্ধেবেলায় তিনি রামব্রিজকে তিন টাকা বকশিশ দিয়েছিলেন। এর ফলে আজ রামব্রিজ নিজেই প্রচুর পরিমাণ ধেনো মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে পড়েছে। আর এতক্ষণে প্রেক্ষাগৃহের প্রধান দরজাতেও নির্ঘাত তালা পড়ে গেছে। তাই রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় বাড়ি ফেরার কোনো উপায় খুঁজে না-পেয়ে প্রশ্নের মন্তব্যটি করেছেন।
প্রশ্ন:-“মুখের ভেতরটা যেন অডিটোরিয়াম- ইন্টারভ্যালে সব দর্শকরা হাঁটাহাঁটি লাগিয়ে দিয়েছে...” – মন্তব্যটির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এর সার্থকতা বিচার করো।
উত্তর : প্রসঙ্গ : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' নাটকে দেখ যায় যে, মধ্যরাতে এক পেশাদারি থিয়েটারের শূন্য প্রেক্ষাগৃহের প্রায় অন্ধকার ফাঁকা মঞ্চে আটষট্টি বছরের প্রবীণ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে প্রবেশ করেছেন। তাঁর পরনে ছিল সদ্য সমাপ্ত হওয়া নাটকের দিলদার চরিত্রে অভিনয় করার পোশাক। অভিনয়ের পর মদাপ অবস্থায় তিনি গ্রিনরুমে ঘুমিয়ে পরেছিলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখেন নাটকের অন্যান্য চরিত্রাভিনেতা সবাই চলে গিয়েছেন। নিস্তব্ধ রাতের শূন্য প্রেক্ষাগৃহে তিনি কেবল একা। মদের নেশা কাটলে শুকনো গলায় তৃয়ার্ত রজনীকান্তে মনে হয়েছে অতিরিক্ত মদ্যপানে তাঁর বুকের ভিতরটা যেন কাঁপছে আর শারীরিক কষ্ট হচ্ছে। তাঁর মুখের ভিতরটা যেন একটা অডিটোরিয়াম যেখানে বিরতিতে সব দর্শকরা চলাচল করছে।
মন্তব্যের সার্থকতা:
'অডিটোরিয়াম' বলতে সাধারণত প্রেক্ষাগৃহকে বোঝানো হয়, যেখানে মঞ্চের সামনে দর্শকদের বসার জন্য থাকে সারিবদ্ধভাবে আসন, যা খাপে খাপে ক্রমশ উপরের দিকে চলে যায়। ইনটারভ্যালে দর্শকরা নিজের আসন ছেড়ে নানা প্রয়োজনে প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে চলাফেরা করে। নেশাগ্রস্থ রজনীকান্তের অবচেতন মনে হয়তো থিয়েটারের নানা দৃশ্যপট কাজ করছিল। তাই মুখর শুকিয়ে এলে তৃষার্ত জিহ্বার যে কষ্ট তিনি অনুভব করেছেন, তার সঙ্গে তুলনা করেছেন অডিটোরিয়ামে নাট্যাভিনয়ের সময় দর্শকদের অবিন্যস্ত চলাচলের দৃশ্যকে।
প্রশ্ন: “জীবনে তোর নেই, সকাল নেই, দুপুর নেই,—সন্ধেও ফুরিয়েছে—এখন শুধু মাঝরাত্তিরের অপেক্ষা”—এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে বক্তার যে মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে তা আলোচনা করো।
উত্তর : প্রসঙ্গ: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' নাটকে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় জীবনের প্রান্তে এসে একদিন দিলদারের চরিত্রে অভিনয় শেষে মদ্যপান করে গ্রিনরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। ঘুম ভাঙার পর অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ অবস্থায় রজনীকান্ত যেন দুর্বিষহ বাস্তবের মুখোমুখি হন।
বক্তার এমন মনোভাবের কারণ : রজনীবাবু টের পান এভাবে আটষট্টি বছর অতিক্রম করে মৃত্যুর শিয়রে এসে পৌঁছেছেন। এখন তাঁর একমাত্র সম্বল সোনালি অতীত। এখন তিনি একজন ফুরিয়ে যাওয়া মানুষ। তাঁকে বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকে অভিনয়ের সেইসব বর্ণময় মুহূর্তগুলি। যখন তাঁর আশ্চর্য প্রতিভার চরিত্রগুলি নতুন রঙে নতুন চেহারায় প্রাণবন্ত হয়ে উঠত। অথচ আজ থিয়েটারের দেয়ালে কালো কালো অক্ষরে জীবনের শেষ কথাগুলো তিনি ফুটে উঠতে দেখেন। এ সময়ে তাঁরই সমবয়সিরা হেঁটে-বেড়িয়ে ভগবানের নাম করে পরম নিশ্চিন্তে জীবন কাটান আর বৃদ্ধ নেশাগ্রস্ত রজনীকান্ত নৈরাশ্যে-বস্ত্রণার মধ্যরাত্রে আবোলতাবোল বকে চলেন। এই অস্থির-আক্ষেপ আসলে শিল্পী রজনীকান্তের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ের হাহাকার। তাঁর প্রতিভা থাকলেও বয়স পেরিয়ে গেছে। এক 'বুড়ো রজনী চাটুজ্জে' মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে পথরোধ করে দাঁড়ানোর; আবেগে হতাশায় রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রশ্নোকৃত মন্তব্যটি করেছেন।
প্রশ্ন: “এখন শুধু মাঝরাত্তিরের অপেক্ষা – এখানেই গল্প শেষ।”-বক্তা কীভাবে জীবনের এই চরম সত্যে উপনীত হলেন তা বুঝিয়ে দাও।
উত্তর : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'নানা রঙের দিন' একাঙ্ক নাটকটিতে এক শিল্পীর আত্মোপলব্ধির স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে।
মানবজীবনের অমোঘ নিয়ম : পেশাদারি থিয়েটারের ফাঁকা মঞ্চে জড়িয়ে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবনের আত্মানিরীক্ষণ করেছেন। নিরুদ্ধ রাস্তে লিমাতের পোশাক পরিহিত রজনীকান্ত নেশাগ্রস্ত অবস্থায় টুলের ওপর বসে আত্মকথনে মগ্ন। নিজের জীবনের উত্থান-পতনের স্বরূপ উপলব্ধি করতে গিয়ে তিনি অতীতের নানা কথা স্মরণ করেছেন। একসময় তিনি অভিনয়ের জন্য ত্যাগ করেছিলেন প্রেমিকাকে।। শিল্পকে ভালোবেসে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় অতিবাহিত করেছেন থিয়েটারে। থিয়েটারই ছিল তাঁর আত্মার সঙ্গী, পরম ভালোবাসা। পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে থিয়েটারের জন্য তিনি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, ব্যক্তিগত জীবনের দুঃখ-কষ্ট উপেক্ষা করে নিরলসভাবে মানুষকে আনন্দ দিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর দুঃখ-যন্ত্রণা-ব্যাথার শরিক কেউ হয়নি কখনও। তিনি বুঝেছেন এক পা এক-পা করে তিনি ক্রমশ এগিয়ে চলেছেন জীবনের অন্তিম লগ্নে। জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এখন মাঝরাত্তিরের জন্য অপেক্ষমাণ।
প্রকৃতি ও মানবজীবন : প্রকৃতির নিয়মেই পৃথিবীতে দিনরাত্রি সংঘটিত হয়। দিনের সূচনা হয় ভোরের স্নিগ্ধতায়, এরপর ক্রমশ ভোর থেকে সকাল, সকাল পেরিয়ে দুপুর, দুপুরের পর বিকেল, বিকেলের পর সন্ধ্যা এবং সন্ধ্যার পর শেষ সময় রাত্রি। একইভাবে মানুষের জীবনও নানা পর্যায় অতিক্রম করে এগিয়ে চলে। বালা, শৈশব ও কৈশোরের পরে আসে যৌবনকাল মানবজীবনের সেরা সময় ব্যাপ্তিকাল। এরপর যৌবনের পড়ন্তবেলায় আসেয়বার্ধক্য। তারপর একটু একটু করে কেবল অপেক্ষা করা মধ্যরাতের জন্য।
মানবজীবনের যথার্থ এই স্বরূপ উপলব্ধি করে রজনীকান্ত এমন উক্তি করেছেন।
প্রশ্ন: “রজনীবাবু ভয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে যান। রজনীবাবুর ভয় পাওয়ার কারণ কী ছিল?
উত্তর : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'নানা রঙের দিন' নাটকের মুখ্য চরিত্র বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় জীবনের প্রান্তে এসে পঁয়তাল্লিশ বছর অভিনয় জীবনের আত্মনিরীক্ষণ করেছেন। মধ্যরাতে শূন্য প্রেক্ষাগৃহের ফাঁকা মঞ্চে একটি জ্বলন্ত মোমবাতি হাতে নিয়ে স্বগতোক্তির মাধ্যমে নিঃসঙ্গ জীবনের অতীতকে তিনি স্মরণ করেছেন।
একদা অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেতা রজনীবাবু অনুভব করেন আটষট্টি বছর অতিক্রম করে তিনি এখন মৃত্যুর শিয়রে উপস্থিত। তাঁর সোনালি অতীতের গৌরব-শশী এখন অস্তগামী। তিনি বোঝেন, এই বৃদ্ধ বয়সে তাঁর শরীরের দিকে নজর দেওয়া উচিত। অতিরিক্ত মদ্যপান করা ঠিক নয়। তবু তিনি মদ ছাড়তে পারেন না। একদিকে পরিবার-স্বজনহীন হওয়ার নিঃসঙ্গতার বেদনা, অন্যদিকে হতাশার গ্লানি তাঁকে মদ ছাড়তে দেয় না। একটু একটু করে তিনি এগিয়ে চলেছেন মৃত্যুর দিকে। তাঁর জীবনের ভোর, সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা শেষ হয়েছে, “এখন শুধু মাঝরাত্তিরের অপেক্ষা”— জীবনের এই শাশ্বত অনিবার্যতাকে অস্বীকার করার উপায় তার নেই। নাটকের ভাষায় যদি তিনি বলতে চান, “আমি লাস্ট সিনে প্লে করব না ভাই, আমাকে ছেড় দিন।”—জীবন তা মানবে না। তিনি না চাইলেও জীবনের গল্প একদিন শেষ হবেই, “শ্মশানঘাট—পরিচিত বন্ধু-বান্ধব, ওপারের দ্রুত উইংসে রেডি।” তাদেরকে উপেক্ষা করার সাধ্য তাঁর নেই।
জীবনের নানা আবেগঘন মুহূর্ত উপলব্ধি করতে করতে রজনীবাবু যখন নিরাশার ও নিঃসঙ্গতার হাহাকারে মুহ্যমান তখন হঠাৎ এলোমেলো চুল ও কালো চাদর পরে প্রম্পটার কালীনাথ মঞ্চে প্রবেশ করে। তাকে দেখে রজনী ভয়ে চিৎকার করে পিছিয়ে যান। আত্মচিন্তন ও আত্মকথনে মগ্ন জীবনের মধ্যরাতে মৃত্যুর প্রতীক্ষায় দিন গুণতে থাকা এক বৃদ্ধের কাছে কালীনাথের হঠাৎ আগমন ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।
প্রশ্ন : "আমি রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে গ্রিনরুমে ঘুমোই চাটুজ্জেমশাই—কেউ জানে না”–বক্তা গ্রিনরুমে ঘুমান কেন?
উত্তর : প্রশ্নোদৃত অংশটির বক্তা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' নাটকের প্রশ্নটার কালীনাথ সেন। নাটক শেষ হলে প্রতিদিন তিনি গ্রিনরুমকে ঘুমোনোর জায়গা হিসেবে ব্যবহার করেন, যদিও সে-কথা মালিক জানে না।
গ্রিনরুমে ঘুমোনোর কারণ : নাটক সমাপ্ত হয়ে যাওয়ার পরও ঘুম থেকে উঠে পেশাদারি থিয়েটারের ফাঁকা অন্ধকার মঞ্চে যখন একাকী
রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় অস্থির, ভীত, বেসামাল এবং তিনি উইংস দিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করলে ময়লা পাজামা ও কালো চাদর গায়ে এলোমেলো চুলে আর-এক বৃদ্ধ এসে ঢোকেন। তিনি প্রম্পটার কালীনাথ সেন। প্রথমে বৃদ্ধ রজনীবাবু কালীনাথকে চিনতে পারেনি। পরে তার পরিচয় জানতে পারল এত রাতে তিনি কী করছেন জানতে চাইলে বৃদ্ধ কালীনাথ সেন জানান তার
শোয়ার জায়গা না-থাকায় তাকে গ্রিনরুমে ঘুমোতে হয়। তখন এই মানুষটির চালচুলোহীন হতদরিদ্র অবস্থাটি সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়। নাটককে ভালোবেসে নিজের ব্যক্তিজীবনের সুখস্বাচ্ছন্দ্যের দিকে তাকাননি কালীনাথ সেন। তাই তিনি রজনীবাবুকে বলেছেন গ্রিনরুমে ঘুমানোর কথাটা যেন মালিকের কানে না-যায়, তাহলে তিনি বেঘোরে মারা পড়বেন এবং শোয়ার জায়গাটুকু চলে যাবে। অর্থাৎ প্রশ্নোদ্ধৃত উক্তির মধ্যে তৎকালীন সময়ে নাটকের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের জীবনের দারিদ্র্য, অসহায়তা ও বঞ্ছনার অন্ধকার দিকটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন:- “ধু-ধু করা দুপুরে জ্বলন্ত মাঠে বাতাস যেমন একা— যেমন সঙ্গীহীন—তেমনি”–অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার যে করুণ ছবি ‘নানা রঙের দিন' নাটকে ফুটে উঠেছে, তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।
উত্তর : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' নাটকের নায়ক পেশাদারি থিয়েটারের এক বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। যৌবনের বর্ণময় জীবনকে অতিক্রম করে তিনি জীবনসায়াহ্নে এসে পৌঁছেছেন। এখন নাটকে
অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে তাঁকে অভিনয় করতে হয়। এভাবে ক্রমশ খ্যাতি প্রতিপত্তি ও খাতিরকে পিছনে ফেলে, সব কিছুকেই বিবর্ণতার আধারে তলিয়ে যেতে দেখে তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন। মদের নেশায় নিজেকে ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। তাঁর বিশ্বাস, মঞ্চের বাইরে অভিনেতার কোনো কদর নেই। তিনি অভিনয়ের জন্য এখনও ক্ল্যাপ পান কিংবা প্রশস্তিসূচক মন্তব্য শোনেন। কিন্তু ওটুকুই। বৃদ্ধ মাতাল রজনীকান্ত চাটুজ্জের কেউ খোঁজ রাখে না। কোনো দর্শক তাঁকে মাতাল অবস্থায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথাও ভাবে না। এমন একটাও লোক নেই যে আদর করে তাঁর সঙ্গে দুটো কথা বলবে। বয়স্ক মানুষটাকে হাত ধরে বিছানায় শুইয়ে দেবে। মরবার সময়ে মুখে দু-ফোঁটা জল দেবে, এমন কেউ নেই তাঁর। নিঃসঙ্গতার এই তীব্র কষ্টে
ও যন্ত্রণায় বৃদ্ধ রজনীকান্ত হাহাকার করে ওঠেন। নিরাশ্রয়-নিরাপত্তাহীনতার গভীর অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলতেই তিনি জ্বলন্ত মাঠের বাতাসের একাকিত্বের সঙ্গে নিজের নিঃসঙ্গ জীবনের তুলনা করেছেন।
প্রশ্ন: “দেয়ালে অঙ্গারের গভীর কালো অক্ষরে লেখা, আমার জীবনের পঁয়তাল্লিশটা বছর”-‘নানা রঙের দিন' নাটক অবলম্বনে উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর : প্রসঙ্গ : 'নানা রঙের দিন' নাটকে নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
এক বৃদ্ধ প্রতিভাবান অভিনেতার জীবননাট্যকে উন্মোচন করেছেন। এ নাটকের প্রধান চরিত্র রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তিনি একদিন অভিনয় শেষে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় গ্রিনরুমে ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে ফাঁকা মঞ্চে দাঁড়িয়ে একাকিত্বে-হতাশায় তিনি প্রম্পটার কালীনাথ সেনের কাছে নিজের বর্ণময় অতীতের স্মৃতিচারণ করতে শুরু করেন।
তাৎপর্য : রাঢ় বাংলার এক ভদ্র ব্রাক্ষ্মণ বংশে রজনীকান্ত জন্মেছিলেন। কিন্তু নাটকের প্রতি অদম্য ভালোবাসায় রজনীকান্ত পুলিশের চাকরি ছেড়ে দেন। নাটককে অবলম্বন করেই যশ-প্রতিপত্তি ও খাতিরে পূর্ণ হয়ে ওঠে তাঁর জীবন। এসময় একটি মেয়ে তাঁর প্রেমে পড়ে। বিয়ের স্বপ্ন দেখেন। রজনীকান্ত, কিন্তু বিয়ের আগে থিয়েটার ছাড়ার প্রস্তাব মেনে নিতে
পারেন না। সেদিন তিনি উপলব্ধি করেন অভিনেতার কদর শুধু মঞ্চে। অভিনেতা আসলে একজন ভাঁড়, যার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি বা সম্মান নেই। এরপর থেকে এলোমেলো হয়ে ওঠে রজনীকান্তের অভিনয় জীবন। তিনি আবোলতাবোল সব পার্ট করতে থাকেন। ক্রমশ ব্যক্তিগত জীবনে একাকিত্ব ও হতাশায় তিনি ডুবে যেতে থাকেন। এই আঘাত-যন্ত্রণা ও নিঃসঙ্গতাকেই তিনি প্রেক্ষাগৃহের দেয়ালে দেয়ালে কালো অঙ্গারে ফুটে উঠতে দেখেছেন।
প্রশ্ন: “একদিন একটা মেয়ে থিয়েটার দেখে প্রেমে পড়ল আমার!”-বক্তা মেয়েটির রূপের যে-বর্ণনা দিয়েছেন তা লেখো। প্রেমের পরিণতি কী হয়েছিল ?
অথবা, “মরে যাব তবু ভুলব না,” যে রূপে মুগ্ধ হয়ে বক্তা এমন মন্তব্য করেছেন সেই রূপের বর্ণনা দাও। ভুলতে না-পারার পরিণতি কী হয়েছিল?
উত্তর : মেয়েটির রূপের বর্ণনা : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নানা রঙের দিন' নাটকে মেয়েটি উদ্ধৃতাংশের বক্তা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমে পড়েছিল। রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যার কালীনাথ সেনকে তাঁর অতীতের কথা বলতে
গিয়ে তাঁর প্রেমের কথা বলেছেন। রজনীবাবুর মতে তখন তিনি সবে নাটকে নেমেছেন তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে একটি মেয়ে তার প্রেমে পড়ে। রজনীবাবুর বর্ণনা অনুসারে সে বেশ বড়োলোকের মেয়ে, বেশ সুন্দর দেখতে—লম্বা, ফরসা, সুন্দর ছিপছিপে গড়ন। মেয়েটি ছিল উঠতি বয়সের—মনটা খুবই সুন্দর। তার টানাটানা কালো চোখ দেখে মনে হত কোনো অচেনা দিনের আলো। তার
অদ্ভুত হাসি আর ঢেউখেলানো রাশি রাশি কালো চুলে ছিল আশ্চর্য এক শক্তি। মেয়েটির রূপের অপূর্ব স্নিগ্ধতা দেখে রজনীর এদিন মনে হয়েছিল সে যেন ভোরের আলোর চেয়েও সুন্দর। তার সেই রূপের ছটা রজনীকান্তকে মোহিত করে দিয়েছিল।
প্রেমের পরিণতি : রজনীকান্তের মতে মেয়েটির সহজসরল। মনে কোনো জটিলতা ছিল না। রজনীকান্ত তাঁর হৃদয়ের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন পশ্চিম আকাশের সূর্যাস্তের আগুন। অভিনয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত রজনীকান্ত বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে একদিন মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু । মেয়েটি বিয়ের আগে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে থিয়েটার ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। সেদিন রজনীকান্ত উপলব্ধি করেন ধনী ঘরের সুন্দরী মেয়ে জীবনভর
নাটকের অভিনেতার সঙ্গে প্রেম করলেও বিয়ে করে সংসার করার কথা ভাবতেও পারে না। অর্থাৎ তাঁদের প্রেম বিবাহে রূপান্তরিত হয় না। তাই।সারাজীবন নিঃসঙ্গ অবিবাহিত থেকে যান রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন: “সে কী আশ্চর্য মেয়ে কেমন করে বোঝাব তোমাকে?”-মেয়েটি সম্পর্কে বক্তার অনুভূতির পরিচয় দিয়ে ঘটনার পরিণতি কী হয়েছিল লেখো।
অথবা, “ও কী বলল জানো?”—প্রসঙ্গ নির্দেশ করে 'সে' কী বলেছিল আলোচনা করো।
উত্তর : মেয়েটি সম্পর্কে রজনীকান্তের অনুভূতি : ‘নানা রঙের দিন' নাটকে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় বিবর্ণ বর্তমানের হতাশা-যন্ত্রণাকে দূরে সরিয়ে ক্রমে সোনালি অতীতের দিনগুলিতে ফিরে যান। তখন তিনি এক প্রতিভাবান তরুণ অভিনেতা। যশ-প্রতিপত্তি ও ঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ তাঁর জীবন। এসময় আলমগিরের চরিত্রে অভিনয় দেখে একটি মেয়ে প্রেমে পড়ে তাঁর। ধনী ঘরের এই মেয়েটি সুন্দর দেখতে ছিল আর মেয়েটির সহজসরল মনে কোনো জটিলতা ছিল না। রজনীকান্ত তাঁর হৃদয়ের মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন পশ্চিম আকাশের সূর্যাস্তের আগুন। তাঁর টানাটানা কালো চোখে যেন প্রতিফলিত হত কোনো অচেনা দিনের আলো। মেয়েটির দীর্ঘ কালো চুলে লুকিয়ে ছিল সমুদ্রের ঢেউয়ের আশ্চর্য শক্তি। ভোরের আলোর চেয়েও সুন্দর এই মেয়েটি প্রেমের অপ্রতিহত শক্তিতে রজনীকান্তকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তাঁর একরকম অদ্ভুত করে চেয়ে থাকার সম্মোহন রজনীকান্তক আজও তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।
ঘটনার পরিণতি : অভিনয়ের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নিশ্চিত রজনীকান্ত বিপুল প্রত্যাশা নিয়ে একদিন মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মেয়েটি বিয়ের আগে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়কে থিয়েটার ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে।
সেদিন রজনীকান্ত উপলব্ধি করেছিলেন ধনী ঘরের সুন্দরী মেয়ে জীবনভর নাটকের অভিনেতার সঙ্গে প্রেম করলেও বিয়ে করে সংসার করার কথা ভাবতেও পারে না ।
প্রশ্ন: “সেই রাত্রেই জীবনে প্রথম মোক্ষম বুঝলুম যে, যারা বলে ‘নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প—তারা সব গাধা”—বক্তা কখন এবং কেন এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন নিজের ভাষায় আলোচনা করো।
অথবা, “এই পবিত্রতার নামাবলিটা সেদিন হঠাৎই ফাঁস হয়ে গেল আমার সামনে”-বক্তার এমন মন্তব্যের কারণ আলোচনা করো।
উত্তর: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' নাটকের প্রধান চরিত্র বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। মধ্যরাতে দর্শকশূন্য প্রেক্ষাগৃহে দাঁড়িয়ে নেশাগ্রস্ত রজনীকান্ত নিজের যৌবনের সোনালি অতীতে ফিরে যান।
একে একে তাঁর মনে পড়তে থাকে পরিবার-চাকরি-অভিনয় প্রতিভা-খ্যাতি ও প্রতিপত্তির কথা। এ প্রসঙ্গেই স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে তাঁর একমাত্র প্রেমের ঘটনার কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত।
বক্তার প্রশ্নোদ্ধৃত সিদ্ধান্তে পৌঁছোনোর কারণ : একটি মেয়ে রজনীকান্তের অভিনয় দেখে তাঁর প্রেমে পড়েছিল। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠতা ক্রমে প্রেমেয়পরিণত হলে রজনীকান্ত মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। কিন্তু মেয়েটি বিয়ের আগে তাঁর কাছে থিয়েটার ছেড়ে দেওয়ার শর্ত আরোপ করে। নাটক-অন্ত প্রাণ রজনীকান্ত প্রেমিকার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের সেই রাতেই উপলব্ধি করেন অভিনেতা আসলে একটা ভাঁড়। সে সার্কাসের ক্লাউন বা জোকারের মতো দর্শকের মনোরঞ্জন করে মাত্র। এই মেডেল করতালি - প্রশংসা - সার্টিফিকেট শুধু মঞ্চে অভিনয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তব জীবনে অভিনেতার কোনো
সামাজিক স্বীকৃতি বা প্রতিষ্ঠা নেই।
নাট্যাভিনয়ের পবিত্রতার নামাবলির পদাটা সেদিনই রজনীকান্তের কাছে ফাঁস হয়ে যায়। নিজের খ্যাতি, প্রতিপত্তি ও দর্পের কাচের স্বর্গটা চুরমার হয়ে ভেঙে পড়ে। এখানে আক্ষেপ ও যন্ত্রণার এই আত্মোপলব্ধিকে ফুটিয়ে তুলতেই
তিনি প্রশ্নোদ্ধৃত মন্তব্যটি করেছেন।
প্রশ্ন: নানা রঙের দিন' নাটকে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছেন—“যারা বলে নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প, তারা সব
গাধা” আবার অন্যত্র বলেছেন—“শিল্পকে যে-মানুষ ভালোবেসেছে তার বার্ধক্য নেই কালীনাথ, একাকিত্ব নেই”—রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের দু-বার দু-রকম উপলব্ধির কারণ কী?
অথবা,“রজনীকান্তের চরিত্রের মধ্যে একজন অভিনেতার চিরকালীন যন্ত্রণাই
প্রকাশিত হয়েছে।”- আলোচনা করো।
উত্তর : নাটকের প্রথমাংশে রজনীবাবুর উপলব্ধি: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' নাটকে প্রতিভাবান অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রেক্ষাগৃহে দাঁড়িয়ে একলা মদ্যপ অবস্থায় নিজের যৌবনের সোনালি অতীতে
ফিরে যান। স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে ওঠে তাঁর পূর্বজীবনের, বিশেষত একমাত্র প্রেমের ঘটনার কিছু অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। প্রেমের পরিণতি স্বরূপ।রজনীকান্ত মেয়েটিকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে মেয়েটি বিয়ের আগে তাঁর কাছে থিয়েটার ছেড়ে দেওয়ার শর্ত আরোপ করে। নাটক-অন্তপ্রাণ রজনীকান্ত প্রেমিকার সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের সেই রাতেই উপলব্ধি করেন অভিনেতা আসলে ভাঁড়। সে সার্কাসের ক্লাউন বা জোকারের মতো দর্শকদের মনোরঞ্জন করে মাত্র। এই মেডেল-করতালি -প্রশংসা সার্টিফিকেট শুধু মঞ্চে অভিনয়ের
মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তবজীবনে অভিনেতার কোনো সামাজিক স্বীকৃতি বা প্রতিষ্ঠা নেই। তাই রজনীবাবুর প্রথম উপলব্ধি – 'যারা বলে নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প, তারা সব গাধা।”
নাটকের পরবর্তী অংশে উপলন্ধির বিবর্তন : রজনীবাবু আবার পরক্ষণেই তাঁর নাট্যাভিনয়ের গৌরবোজ্জ্বল অতীতের স্মৃতিচারণ করেন। নির্ভীক 'বন্ধিয়ার', নিঃসঙ্গ রক্তাক্ত 'ঔরাজীব কিংবা পিয়ারাবানুকে বলা সুজার শেষ
সংলাপের প্রেমমগ্ন আবেগে রজনীকান্ত খুঁজে পান নিজের দুঃখময় জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি নাটককে ভালোবেসেই তো চাকরি ছেড়েছেন, বিসর্জন দিয়েছেন প্রেম; যৌবন, আদর্শ, শক্তি, সম্ভ্রম ও নারী—এসব কিছুকে নাটকে এসেই তিনি নির্দ্বিধায় উৎসর্গ করেছেন। তাই আজ তিনি উপলব্ধি করেছেন,'আমার প্রতিভা এখনও মরেনি।' আর শিল্পকে যে মানুষ ভালোবেসেছে
বার্ধক্য, একাকিত্ব, রোগ কিংবা মৃত্যুভয়ও গ্রাস করতে পারে না।
শিল্পীসত্তার জন্ম ও এক অভিনেতার চিরন্তন দ্বন্দ্ব-যন্ত্রণার প্রকাশ : এভাবেই প্রথমে রজনীবাবু হতাশাগ্রস্ত হন, কারণ তিনি বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে দিলদারের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। যৌবন-সম্ভ্রম-প্রেম ও নারী একে একে ছেড়ে যাওয়ার আক্ষেপ ও যন্ত্রণা তাকে আবেগবিহ্বল করে তোলে।
তবে একইসঙ্গে শিল্পীসত্তার প্রশ্নে তিনি আপসহীন, কেন-না তাঁর বিশ্বাস এক শিল্পীর কাছে শিল্পসৃষ্টির তাগিদ ছাড়া বাকি সব তুচ্ছ। তাঁর জীবনের চরমতম সত্য হল শিল্পের প্রতি ভালোবাসা ও সৃষ্টিশীলতার প্রতি চূড়ান্ত আত্মনিবেদন।
এই চূড়ান্ত অন্তর্বর্ণ এক শিল্পীর জীবনের পর্ব থেকে পর্বান্তরের চিরকালীন যন্ত্রণাকেই ফুটিয়ে তোলে।
প্রশ্ন: ... প্রাক্তন অভিনেতা রজনী চাটুজ্জের প্রতিভার অপমৃত্যুর- 'করুণ সংবাদ!”- বক্তার উল্লেখসহ এই অপমৃত্যু কীভাবে ঘটে বলে বক্তা মনে করেন?
উত্তর : বক্তা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' নাটক থেকে সংকলিত প্রশ্নোদৃত উক্তিটির বক্তা হলেন নাটকের মুখ্য চরিত্র রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ।
প্রতিভার অপমৃত্যুর ঘটনা: রজনী চাটুজ্জে আটষট্টি বছর বয়সে এসে পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবনের স্মৃতিচারণায় মগ্ন হয়েছেন। কমবয়সে তিনি যখন অভিনয় জীবনে আসেন তখন একটি মেয়ে তাঁর অভিনয় দেখে প্রেমে পড়ে। সেই মেয়েটি তাঁকে বিয়েও করতে চায়, কিন্তু শর্ত হিসেবে মেয়েটি জানায় রজনী যদি অভিনয় ছেড়ে দেয়, তবেই সে বিয়ে করবে।
সেদিন তিনি বুঝতে পারেন, যারা বলে 'নাট্যাভিনয় একটি পবিত্র শিল্প, তারা সব গাধা। তারপর থেকে সেই মেয়েটির আর কোনো খোঁজ পাননি; তবে তাঁরও আর কিছু ভালো লাগত না। ভবিষ্যৎ চিন্তা, ভালো নাটক বাছাই করা বা ভালো চরিত্র ফুটিয়ে তোলা—এসব একে একে লাটে উঠল। বয়স বাড়ল, গলার কাজ নষ্ট হয়ে গেল, একটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতাও নষ্ট হয়ে গেল। সেদিন রজনী দেখতে পেলেন—কোনো অদৃশ্য হাত থিয়েটারের দেয়ালে অঙ্গারের কালো কালো অক্ষরে লিখে দিয়ে গেল, রজনী চাটুজ্জের প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ।
প্রশ্ন:- “কী সহজে একটা চরিত্র বুঝতে পারতাম—কী আশ্চর্য সব নতুন রঙের চরিত্রগুলো চেহারা পেত।”–বক্তার এমন মন্তব্যের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : অভিনয়ের প্রতি ভালোবাসা : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত “নানা রঙের দিন' নাটাকে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় জীবনের অন্তিম বেলায় দর্শকশূন্য প্রেক্ষাগৃহে পাঁড়িয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় যৌবনের সোনালি অতীতকে স্মরণ করেছেন। অভিনয়কে ভালোবেসে তিনি পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দ, প্রেম-ভালোবাসা সবই বিসর্জন দিয়েছিলেন। অভিনয় ছিল তাঁর জীবনের পরম ব্রত, তাঁর প্রথম ভালোবাসা। পুলিশের উচ্চপদে চাকরি, পারিবারিক সুখ, প্রেমের মোহময়তা—সব কিছুই তিনি পরিত্যাগ করেছিলেন এই থিয়েটারের জন্য। যৌবনে তাঁর অভিনয় দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে যে প্রেমিকা তাঁর জীবনকে আলোকিত করার স্বপ্ন দেখিয়েছিল, বিয়ের শর্ত হিসেবে অভিনয়
ছাড়ার কথা বললে সেই প্রেমিকাকে তিনি চিরতরে মুক্তি দিয়েছিলেন – তবু অভিনয়-বিমুখ হননি। নিঃসঙ্গ জীবনে অভিনয়কে আঁকড়ে তিনি পঁয়তাল্লিশ বছর অনায়াসে কাটিয়ে দিয়েছিলেন।
হতাশা : আটষট্টি বছরের বৃদ্ধ রজনীকান্ত এখন বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত, গলার স্বর হয়েছে বিকৃত। চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করে চরিত্রকে যথার্থ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতাও হারিয়েছেন। তাঁর অভিনয় প্রতিভা তাঁকে ছেড়েয়গেছে। জীবনের ভরা পাত্র আজ শূন্যতায় রিক্ত হয়ে গেছে। তাঁর দুকুলহারা নিঃসঙ্গ জীবনে এখন শুধুই হতাশা। অথচ কী আশ্চর্য অভিনয় দক্ষতা ছিল তাঁর। দর্শক তাঁর অভিনয়ে মুগ্ধ হয়ে 'ক্ল্যাপ' দিত, প্রশংসায় ভরিয়ে দিত। বিভিন্ন নাটকের বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্র তাঁর অভিনয়গুণে বাস্তব রূপ পেত। চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করে চরিত্রগুলির বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ বৈশিষ্ট্য বুঝতে পারার আশ্চর্য দক্ষতা ছিল রজনীর। প্রম্পটার কালীনাথ-এর কাছে রজনী চাটুজ্জে তাঁর
এই অভিনয় প্রতিভার স্মৃতিচারণা প্রসঙ্গেই প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেছিলেন।
প্রশ্ন :; “ধরো ধরো 'সাজাহান' নাটকের ঔরঙ্গজীবের সেই ভয়ংকর সিনটা”– ঔরাজীবের সেই ভয়ংকর সিনটার বর্ণনা দাও।
উত্তর : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' নাটকের প্রশ্নোদ্ধৃত অংশে বৃদ্ধ রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে কালীনাথের সামনে
তাঁর অতীতের সোনালি দিনগুলি স্মরণ করতে থাকেন। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কখনও তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে 'রিজিয়া' নাটকে বক্তিয়ারের কথা, আবার কখনও 'সাজাহান' নাটকে ঔরঙ্গজীবের সংলাপ। এসময় ভ্রাতৃহত্যার রক্তে রক্তাক্ত ঔরঙ্গজীবের দুঃস্বপ্ন-গ্লানি ও অন্তর্দ্বন্দ্বের অংশটি তিনি অভিনয় করেন। সেই ভয়ংকর দৃশ্যটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’
নাটকের। ঔরাজীব নিজের পিতাকে বন্দি করে এবং অন্যান্য ভাইদের হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করলেও মনের মধ্যে এক চরম আত্মগ্লানিতে ভোগেন। রাত্রে ঔরঙ্গজীবের ঘুম আসে না। যখন সবাইকে খুন করে সিংহাসন পেয়েছেন ঔরঙ্গজীব, তখন মাঝরাতে একাকী ঔরঙ্গজীব নিজের মনেই সান্ত্বনা পেতে চান— যা করেছি ধর্মের জন্য। যদি অন্য উপায়ে সম্ভব হত। উঃ কী অন্ধকার। সেই রাত্রে কোনোমতেই দুশ্চিন্তা দূর করতে পারছিলেন না ঔরঙ্গজীব। তন্দ্রায় ঢুলে পড়ছিলেন তবুও নিদ্রা আসছিল না। এক তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে ও আত্মগ্লানিতে ভুগছিলেন। তিনি মনে করেছেন তাঁকে ঘিরে নাচছে তাঁর দাদা দারার ছিন্ন শির, তাঁর আর-এক দাদা সুজার রক্তাক্ত দেহ। তাঁর ভাই মোরাদের কবন্ধ। জ্যোতির্ময়ী ধূমশিখার মতো মাঝেমাঝে তাঁর জাগ্রত তন্দ্রায় এসে দেখা দিয়েছে তাঁরা। শাজাহান বড়ো ছেলে দারাকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন। কিন্তু ঔরাজীব তাঁকে হত্যা করেন। সিংহাসনের পথকে মসৃণ করতে তিনি এই পাপ কাজে মগ্ন হয়েছিলেন। কিন্তু ভ্রাতৃহত্যার অপরাধ ও আত্মগ্লানি তাঁর পিছু ছাড়েনি—এই ভয়ংকর দৃশ্যই তার প্রমাণ।
প্রশ্ন:; “প্রতিভা যার আছে, বয়েসে তার কী আসে যায়”-প্রসঙ্গসহ বক্তার এমন মন্তব্যের কারণ বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : প্রসঙ্গ : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নানা রঙের দিন' নাটকে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় শূন্য রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে অতীতের স্মৃতিচারণায় ডুব দেন। মধ্যরাতে প্রেক্ষাগৃহের দেয়ালে কালো কালো জ্বলন্ত অক্ষরে যেন
কারো অদৃশ্য হাতে লিখিত হতে দেখেন তাঁর প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ।
বক্তার প্রশ্নোদ্ধৃত মন্তব্যের কারণ : বৃদ্ধ রজনী চাটুজ্জেকে নিজেরই সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় হতাশা ও যন্ত্রণায় শিউরে ওঠেন। তাঁর মনে পড়ে যায়, যৌবনের দিনগুলির কথা, যখন প্রতিভার আশ্চর্য স্পর্শে নাটকের চরিত্রগুলি নতুন রঙে জীবন্ত হয়ে উঠত। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কখনও তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে 'রিজিয়া' নাটকের বক্তিয়ারের কথা, আবার কখনও 'সাজাহান' নাটকের ঔরঙ্গজীবের সংলাপ এসময় ভ্রাতৃহত্যার রক্তে রক্তাক্ত ঔরঙ্গজীবের দুঃস্বপ্ন-গ্লানি ও অন্তর্দ্বন্দ্বের
অংশটি অভিনয় করার পরে তৃপ্তিতে তিনি হাততালি দিয়ে জোরে হেসে ওঠেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারেন প্রতিভার অবিনাশী ঐশ্বর্যের কথা। তিনি টের পান, একে একে আটষট্টিটা বছর অতিক্রান্ত হলেও, প্রতিভা তাঁকে ছেড় যায়নি। তাঁর রক্তের মধ্যে মিশে থাকা প্রতিভার গুণেই তিনি বার্ধক্যকেও পর্যুদস্ত করতে পেরেছেন। একেই এক শিল্পীর জীবনের চিরকালীন সত্য বলে মনে করে, রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেছেন।
প্রশ্ন:-“এই তো জীবনের সত্য কালীনাথ”—জীবনের সত্য কী?-বক্তা কীভাবে এই সত্যে উপনীত হলেন?
অথবা, “এই তো জীবনের সত্য কালীনাথ”–বক্তা জীবনের কোন্ সত্যের
কথা বলতে চেয়েছেন তা আলোচনা করো।
উত্তর : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' একাঙ্ক নাটকে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় আটষট্টি বছর বয়সে অভিনয় শেষের এক রাত্রিতে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় প্রম্পটার কালীনাথ সেনের সঙ্গে কথোপকথনকালে
এমন উপলব্ধি করেছেন।
জীবনের সত্যের স্বরূপ : অভিনয় জীবনের পঁয়তাল্লিশ বছর অতিক্রম করে তিনি অনুভব করেছেন তাঁর জীবন ক্রমশ এগিয়ে চলেছে সমাপ্তির পথে।
যৌবনে তাঁর শরীরে ছিল বল, চেহারায় ছিল জেল্লা, মনে ছিল অফুরন্ত সাহস।কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হয়েছে। থিয়েটারের প্রতি গভীর ভালোবাসায় একসময় তিনি ত্যাগ করেছিলেন পরিবার, স্বজন, প্রেম, সুনিশ্চিত চাকরি। শিল্পকে আঁকড়ে ধরে তিনি বাঁচতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অনুভব করলেন, বয়সের ছাপ ধীরে ধীরে তাঁর অভিনয়ে পড়ছে।
দিন দিন তাঁর খ্যাতি, প্রতিপত্তি কমে যাচ্ছে। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে তাঁর উপলব্ধি, “অভিনেতা মানে একটা চাকর–একটা জোকার, একটা ক্লাউন।”
অভিনেতার সামাজিক কোনো মানমর্যাদা নেই। নাটকওয়ালাদের তাঁর মনে হয়েছে, “একটা ভাঁড় কি মোসায়েবের যা কাজ তাই।”
সত্যের উপলব্ধি : জীবনের সায়াহ্নে উপনীত হয়ে রজনীকান্ত উপলব্ধয়করেছেন যে, শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধতা ও গভীর ভালোবাসা, অভিনয়ে
নিষ্ঠাবান, চরিত্রকে হৃদয়ঙ্গম করে তার গভীরে প্রবেশ করতে পারলে ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট-বেদনা লঘু হয়ে যায়। তিনি এও বুঝেছেন, তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের শোকানল, অনুভূত চিতার আঁচ, সমাগত মৃত্যুর নিশ্বাস শিল্পীর প্রতিভার
কাছে তুচ্ছ ও ক্ষুদ্র হয়ে যায়; প্রতিভাই শেষ কথা বলে। দক্ষ অভিনেতা রজনীকান্তের মধ্যে এই প্রতিভার বিচ্ছুরণ আছে। তিনি মনে করেন, প্রতিভাই পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও বয়সকে তুচ্ছ করে দিতে পারে। জীবনের চিরন্তনী শক্তি হল এই প্রতিভা। রজনীকান্ত মনে করেন “প্রতিভা যার আছে, বয়েসে তার কি আসে যায়।” অভিনেতা রজনীকান্তের কাছে এটাই জীবনের চরম
সত্য। এই জীবনসত্য তাঁর জীবনীশক্তি। জীবনের নানা অপমান, লাঞ্ছনা, বার্ধক্য-জরা এমনকি মৃত্যুভয়কেও তিনি উপেক্ষা করতে পারেন এই জীবনসত্য দিয়েই।
৬৭
अभ
তার বার্ধক্য ন
প্রশ্ন:; “শিল্পকে যে-মানুষ ভালোবেসেছে -
কালীনাথ, ” – “নানা রঙের দিন নাটক অবলম্বনে মন্তব্যটির তাৎপর্য লেখো।
অথবা, "শিল্পকে যে মানুষ ভালোবেসেছে- তার বার্ধক্য নেই কালীনাথ, একাকিত্ব নেই” বলতে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় কী বুঝিয়েছেন আলোচনা করো।
উত্তর : প্রসঙ্গ: 'নানা রঙের দিন' নাটকের মুখ্য চরিত্র রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়।
আটষট্টি বছর বয়সে পৌঁছে তিনি অভিনেতা জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি ক্ষতবিক্ষত হন। তাঁর অভিনয় জীবনের খ্যাতি-প্রতিপত্তি ও উচ্চাশার সোনালি অতীত আজ তাঁর কাছে স্মৃতি মাত্র। ফলে হতাশ ও আহত রজনীকান্তের সুরাসক্তি
বাড়ে। প্রম্পটার কালীনাথের কাছে তিনি শিল্পীহৃদয়ের একাকিত্ব-যন্ত্রণা-অপমান এবং অসম্মানের এই ইতিহাসকেই তুলে ধরেন। এসব কথা বলতে গিয়েই বারবার আঁকড়ে ধরতে চান হারিয়ে যাওয়া পুরোনো দিনগুলিকে।
তাৎপর্য : নির্ভীক 'বক্তিয়ার', নিঃসঙ্গ-রক্তাক্ত 'ঔরঙ্গব্জীব' কিংবা পিয়ারাবানুকে বলা সুজার শেষ সংলাপের প্রেমমগ্ন আবেগে রজনীকান্ত খুঁজে পান নিজের দুঃখময় জীবনের প্রতিচ্ছবি। তিনি নাটককে ভালোবেসেই তো চাকরি ছেড়েছেন, বিসর্জন দিয়েছেন প্রেম; যৌবন, আদর্শ, শক্তি, সম্ভ্রম ও নারী—এসব কিছুকে নাটকের কাছেই নির্দ্বিধায় উৎসর্গ করেছেন। আজ তিনি উপলব্ধি করেছেন, 'আমার প্রতিভা এখনও মরেনি'। অর্থাৎ এক শিল্পীর কাছে শিল্পসৃষ্টির তাগিদ ছাড়া বাকি সব তুচ্ছ। জীবনের চরমতম সত্য হল শিল্পের প্রতি ভালোবাসা ও সৃষ্টিশীলতার প্রতি চূড়ান্ত আত্মনিবেদন। যে-মানুষ শিল্পকে ভালোবেসেছে; সে রোগ, বার্ধক্য, একাকিত্ব ও মৃত্যুভয়কে হেলায় অবজ্ঞা করে চলে। প্রশ্নোদ্ধৃত অংশে শিল্পী রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় সে কথাই
বলতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন: “এই তো জীবনের নিয়ম!”—জীবনের কোন্ নিয়মের কথা বলা হয়েছে? এই উক্তির মধ্য দিয়ে বক্তার কোন্ মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়?
উত্তর : জীবনের কঠোর নিয়ম : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'নানা রঙের দিন' নাটক থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশে জীবনের শাশ্বত নিয়মের কথা বলা হয়েছে। আটষট্টি বছরের বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত জীবনের শেষ লগ্নে
অনেক দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা ও হতাশায় দার্শনিকের মতো জীবনসত্যের অমোঘ নিয়মের কথা ব্যক্ত কালীনাথের কাছে করেছেন। তাঁর কথায়, পৃথিবীতে জন্ম-জরা-মৃত্যু স্বাভাবিক জীবকূলের ওপর প্রভাব বিস্তার করে, শিল্পী তার-ব্যতিক্রম নয়। জগতের এই চিরন্তন নিয়ম সকলকেই মানতে হয়। রজনীকান্তের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।
• বস্তার মানসিকতা : দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছরের অভিনয় জীবনে রজনীকান্ত বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন। তিনি অনুভব করেছেন, যৌবনকালে অভিনয়ের যে দক্ষতা তাঁর ছিল বয়সের ভারে তা নষ্ট হয়েছে। চরিত্রকে বুঝে
চরিত্রের গভীরে প্রবেশ করে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা আগের মতো তাঁর আর নেই। কিন্তু আটষট্টি বছর বয়সেও তিনি মানসিকভাবে অনেক শক্তিশালী। অভিনয়কে ভালোবেসে রজনী জীবনে অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন। অভিনয়
তাঁর জীবনের একটা প্যাশান, অভিনয় তাঁর মনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। তাই তিনি মনে করেন, “শিল্পকে যে মানুষ ভালোবেসেছে—তার
পার্থক্য নেই...একাকিত্ব নেই, রোগ নেই”; শিল্পই তার প্রাণ, তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। প্রকৃত শিল্পপ্রতিভার মৃত্যু হয় না, শিল্পকে যে মানুষ প্রাণপণে ভালোবাসতে পেরেছে, শিল্পই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে
রজনীকান্ত এই জীবনসত্যের সম্মুখীন হন যে, শিল্পের প্রতি ভালোবাসা শিল্পীকে অমরত্ব দান করে। শিল্পীর বহুমুখী প্রতিভা তাকে চিরম্বারী করে
রাখতে পারে।
প্রশ্ন: “আমিও তো মানুষ কালীনাথ।” –কোন্ প্রসঙ্গে বক্তা এমন কথা বলেছেন? বক্তা কেন এমন মন্তব্য করেছেন?
অথবা, “হায়রে প্রতিভা। কোথায় গেল বলো তো?”—প্রসঙ্গ উল্লেখ করে 'নানা রঙের দিন' নাটক অবলম্বনে বক্তার এমন উপলব্ধির কারণ বিশ্লেষণ করো।
উত্তর : প্রসঙ্গ : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' নাটকের মুখ্য চরিত্র আটষট্টি বছরের বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের এমন
উপলব্ধি। একদিন মদ্যপ অবস্থায় মধ্যরাত্রে ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে থিয়েটারের কালো দেয়ালের দিকে তাকিয়ে তিনি মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পান। তিনি
টের পান এই সুদীর্ঘ অভিনয় জীবনে যৌবন, আদর্শ, শক্তি, সম্ভ্রম, প্রেম ও নারী—একে একে সব পার করে এসেছেন। যে অনায়াস সাবলীলতায় তিনি চরিত্রগুলিকে নতুন রঙে ভরিয়ে তুলতে পারতেন, আজ বয়স বাড়ার
সঙ্গে সঙ্গে সেই দক্ষতাও তিনি হারাতে বসেছেন। এভাবে একে একে সব হারাতে বসা এক মানুষের জীবনের দুঃসহ একাকিত্ব আর তার সঙ্গেই
নাটক-অন্তপ্রাণ এক শিল্পীর সামাজিক অবস্থান, —উভয়ের তীব্র টানাপোড়েন দেখে প্রম্পটার কালীনাথ বিস্মিত হন। এর প্রত্যুত্তরেই রজনীকান্ত প্রশ্নোদ্ভূত উক্তিটি করেন।
উপলব্ধির কারণ বিশ্লেষণ : জীবনের প্রাস্তবেলায় পৌঁছে অভিনেতা রজনী চাটুজ্জে তাঁর দ্বৈত-জীবনের কথা ভেবে গভীরভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ব্যক্তিজীবনে মঞ্চের বাইরে তিনি সম্পূর্ণ একা, সমাজ-বিচ্ছিন্ন এবং পরিত্যক্ত। কারণ তাঁর কোনো সঙ্গী-সাথী-পরিবার কিছুই নেই আর দর্শকের কাছে এক অভিনেতার যাবতীয় খাতির মঞ্চের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ফলে মরার সময় দু-ফোঁটা জল দেওয়ারও কেউ নেই তাঁর। অন্যদিকে বয়সের কারণে চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার সামর্থ্য আর গলার কাজ ফুটিয়ে তোলার
সুক্ষ্মতাও নষ্ট হয়ে আসছে। তাই তাঁর মনে হয়েছে, থিয়েটারের দেয়ালে কারও অদৃশ্য হাত অঙ্গারের কালো কালো জ্বলন্ত অক্ষরে লিখে দিয়ে গেছে
অভিনেতা রজনী চাটুজ্জের প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ। এখন তিনি নায়কের চরিত্রের বদলে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। কিন্তু আর কয়েকবছর পর তাঁকে সেখানেও মানাবে না। শুধু ব্যক্তিগত আবেগ ও নাটকের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে তো আর জীবনের পাত্রকে পূর্ণ করা যায় না। এভাবেই শিল্পীর জীবন থেকে প্রতিভা-সম্মান -খ্যাতি ও জৌলুষ একে একে বিদায় নেয়। এখন তাঁর একমাত্র সম্বল স্মৃতির সোনালি অতীত এবং বাস্তবের প্রেমহীন, কমবহীন, মৃত্যুতায় আক্রান্ত বর্তমান। তাই নিঃস্ব, নিঃসন রজনীকান্ত
চট্টোপাধ্যায় আক্ষেপ ও নৈরাশ্যের যন্ত্রণা থেকেই প্রশ্নোদ্ভূত মন্তব্যটি করেন।
প্রশ্ন : “ওথেলোর সেই কথাগুলো মনে আছে তোমার?”-“নানা রঙের দিন' নাটকটির শেষাংশ কী তাৎপর্য তুলে ধরে আলোচনা করো। ৫
উত্তর : শিল্পীদয়ের আর্তি: 'নানা রঙের দিন' নাটকটি পেশাদারি থিয়েটারের বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের শিল্পীহৃদয়ের আর্তি ও আর্তনাদে পরিপূর্ণ। সেখানে তাঁর ফেলে আসা জীবনের প্রতিভার বিচ্ছুরণ যেমন আছে,
তেমনই আছে মৃত্যুর শিয়রে উপস্থিত বৃদ্ধ বয়সের একাকিত্ব, হতাশা ও বেদনার অসহায় হাহাকারের ছবি। তিনি একদিকে উপলব্ধি করেন প্রতিভার
লয়-ক্ষয়-বিনাশ নেই, অন্যদিকে টের পান এই অন্ধকার বর্তমান তাঁকে ক্রমে মজলিশি গল্পের আস্তাকুঁড়ে নির্বাসিত করছে।
তাৎপর্য-রজনীকান্তের হৃদয়ের ক্ষতবিক্ষত প্রকাশ : শিল্পী রজনীকান্ত তাঁর ব্যক্তিজীবনের যন্ত্রণার সাদৃশ্য খুঁজে পান কখনও ওথেলোর সংলাপে,আবার কখনও ম্যাকবেথের অসামান্য খেদ ও আক্ষেপের প্রকাশে। শেকসপিয়রের নাটকের দুটি বিখ্যাত ট্র্যাজিক চরিত্র হল ওথেলো এবং ম্যাকবেথ। ডেসডিমোনোর প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ওথেলো যেমন যুদ্ধক্ষেত্রয়থেকে বিদায় নেন, সেভাবেই প্রিয়তমা স্ত্রীর মৃত্যুতে নিঃসঙ্গ ম্যাকবেথ নিজের সঙ্গে এক অসহায় অভিনেতার চিরবিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়ার তুলনা করেন। এ দুটি চরিত্রের মধ্যে রজনীকান্ত নিজের যন্ত্রণাদগ্ধ ট্র্যাজিক জীবনের মিল খুঁজে পান। নাটকের শেষে মঞ্চের পিছন থেকে ভেসে আসা রিচার্ড দ্য থার্ডের সংলাপে, প্রিয় ঘোড়ার জন্য তাঁর অন্তরের আর্তনাদ আসলে স্মৃতিতাড়িত শিল্পী রজনীকান্তের ক্ষতবিক্ষত হৃদয়কেই
প্রকাশ করে।
প্রশ্ন: 'নানা রঙের দিন' নাটক অবলম্বনে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের চরিত্রবিশ্লেষণ করো।
অথবা, 'নানা রঙের দিন' নাটকে অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের যে নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বের ছবি ফুটে উঠেছে আলোচনা করো।
উত্তর : প্রধান চরিত্র— রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় : অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের
্ "নানা রঙের দিন' নাটকটির প্রধান চরিত্র বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়।
ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে নেশাগ্রস্ত, নিঃসঙ্গ রজনীকান্তের চরিত্রের নানান দিক তাঁর স্মৃতিচারণার সূত্র ধরে একে একে উন্মোচিত হয়।
* নাটকের প্রতি দায়বদ্ধ : রাঢ় বাংলার ভদ্র ব্রাক্ষ্মণ বংশজাত রজনীকান্ত অল্পবয়সেই পুলিশের ইনস্পেক্টর পদে চাকরি পেয়েছিলেন। কিন্তু নাটকের প্রতি অদম্য ভালোবাসার টানে তিনি চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। ক্রমে প্রতিভাবান
অভিনেতা রজনীকান্ত শিল্পসৃষ্টির তাগিদে যৌবন-আদর্শ- শক্তি-সম্ভ্রম-প্রেম ও
নারী এ সব কিছুকেই উৎসর্গ করেন।
নিঃসঙ্গ ও হতাশ : রজনীকান্ত উপলব্ধি করেন দর্শকের মনোরঞ্জনে অভ্যস্ত অভিনেতা আসলে এক ভাঁড় মাত্র, যার কোনো সামাজিক সম্মান
নেই; কেবল রয়েছে সীমাহীন একাকিত্ব আর বয়সের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিভাকে হারানোর দুঃসহ গ্লানি ও হতাশা।
* সংশয় ও দ্বন্দ্বে দীর্ণ : জীবনের শেষপ্রান্তে ধীরে ধীরে মৃত্যুর শিয়রে এসে উপস্থিত হওয়ার নৈরাশ্য রজনীকান্তকে আরও অস্থির ও বিচলিত করে
তোলে। ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে তিনি 'রিজিয়া'-র বক্তিয়ার কিংবা 'সাজাহান'-এর ঔরঙ্গজীব বা শেকসপিয়রের ‘ওথেলো'-র মধ্য দিয়ে বার্ধক্য, ব্যাধি, একাকিত্ব এবং মৃত্যুভয়কে জয় করতে চান; আবার পরমুহূর্তেই স্মৃতি থেকে বাস্তবে
ফিরে জীবনের বিদায়ধ্বনি শুনতে পান।
এভাবেই আক্ষেপ-ভালোবাসা-প্রতিভা ও নৈরাশ্যের দ্বন্দ্বময় টানাপোড়েনে এক নিঃসঙ্গ শিল্পীর অন্তরের একাকিত্বের অনুভূতির ভাষ্যকে প্রকাশ করেন রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়।
প্রশ্ন:-নানা রঙের দিন' নাটক অবলম্বনে প্রম্পটার কালীনাথ সেনের চরিত্রবিশ্লেষণ করো।
অথবা, কালীনাথ সেনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
উত্তর : পার্শ্বচরিত্র-কালীনাথ সেন : 'নানা রঙের দিন' নাটকের পার্শ্বচরিত্র কালীনাথ সেন আজীবন পেশাদারি থিয়েটারে প্রম্পটারের কাজ করেছেন।
তাঁর ভূমিকায় যেমন মঞ্চের আলো পড়ে না, তেমনই জীবনও বঞ্চনার। অন্ধকারে ঢাকা পড়ে থাকে।
সহায়সম্বলহীন : কালীনাথের ময়লা পাজামা ও কালো চাদরে অভাব এবং দারিদ্রের চিহ্ন স্পষ্ট। এরপর তিনি যখন বলেন শোয়ার জায়গা না থাকায় তাঁকে গ্রিনরুমে ঘুমোতে হয়, তখন এই মানুষটির চালচুলোহীন হতদরিদ্র অবস্থাটি সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়।
সহানুভূতিশীল : রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষোভ-বিক্ষোভ-হতাশা-একা কিন্তু কালীনাথকেও আলোড়িত করে। বৃদ্ধ রজনী চাটুজ্জেকে শান্ত করতে কালীনাথ পুরোনো দিনের কথা না-ভাবার পরামর্শ দেন।
নাট্যপ্রেমী : প্রম্পটার কালীনাথেরও যে নাটকের প্রতি দরদ কিছু কম নয়, তা বোঝা যায় যখন তিনি সাবলীলতার সঙ্গে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে মহম্মদের সংলাপ বলতে শুরু করেন। তাই প্রতিভাবান বৃদ্ধ রজনীকান্তের অসামান্য একক অভিনয় তাঁর চোখে জল আনে। শেষে তিনি যখন বলে ওঠেন, 'আমি বলছি রজনী চাটুজ্জে মরবে না—কিছুতেই না—' তখন যেন বৃদ্ধ শিল্পীর প্রতি এক নীরব নাট্যপ্রেমীর শ্রেষ্ঠ স্বীকৃতিবাক্য ধ্বনিত হয়।
এভাবেই কালীনাথ সেন মানবিকতায়-সাহচর্যে ও দুঃখযন্ত্রণার অংশীদারিত্বে একটি সার্থক রক্তমাংসের চরিত্র হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন : ‘নানা রঙের দিন' নাটকের সূচনায় মঞ্চসজ্জার যে বর্ণনা আছে, তা নিজের ভাষায় লেখো। নাটকটির নামকরণ কতখানি সার্থক-তা আলোচনা করো।
উত্তর: মঞ্চসজ্জার বর্ণনা : ‘নানা রঙের দিন' নাটকের সূচনায় মঞ্চসজ্জার যে বর্ণনা আছে, তা এইরূপ–পর্দা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখা যায় একটি পেশাদারি থিয়েটারের ফাঁকা রঙ্গম। প্রায় অন্ধকার সেই মঞ্চে রয়েছে রাত্রে অভিনীত ‘সাজাহান’ নাটকের দৃশ্যপট, আর বেশ কিছু জিনিসপত্র এদিক-ওদিক ছড়ানো । মঞ্চের মাঝে আছে একটি ওলটানো টুল। দর্শক-আসনও একেবারে ফাঁকা।
দ্বিতীয় অংশের উত্তরের জন্য 'নামকরণ' অংশটি দ্রষ্টব্য।
প্রশ্ন:; 'নানা রঙের দিন' নাটকে নাট্যকারের সংলাপ রচনার কৃতিত্ব আলোচনা করো।
উত্তর : নাট্যকার নাট্যবিষয়কে প্রাণবন্ত ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলেন সংলাপের সাহায্যে। তাই সংলাপ হল নাটকের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।
সাধারণত নাটকে আবহ, চরিত্র এবং ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে নাট্যসংলাপ গড়ে ওঠে।
নানা রঙের দিন' নাটকের সংলাপ রচনায় নাট্যকারের কৃতিত্ব : পাঠ্য 'নানা রঙের দিন' নাটকেও নাট্যকার অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় সেই কৌশল অবলম্বন করেছেন। এখানে বৃদ্ধ অভিনেতা রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের অন্তর্মনের
দ্বন্দ্বই হয়ে উঠেছে সংলাপের প্রাণ। মাঝরাতে ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে এক নেশাগ্রস্ত বৃদ্ধের স্বগতোক্তি, স্মৃতিচারণ এবং পুরোনো দিনের বিভিন্ন নাটকের অভিনয়ে উন্মোচিত হয় এক শিল্পীর রক্তাক্ত হৃদনা। এক্ষেত্রে চলতি হিন্দি বুলি ('ক্যায়া হোগা তুম্সে? কুছ নেহি।'), বহুল প্রচলিত বাংলা
লব্জ ('মাইরি, এই না হলে অ্যাকটিং।'), পুরোনো নাট্যসংলাপ (‘শাহাজাদি! সম্রাটনন্দিনী! মৃত্যুভয় দেখাও কাহারে?') প্রভৃতির সঙ্গে শেকসপিয়রীয়
নাটকের (Farewell the tranquil mind! farewell content!) সংমিশ্রণে নাট্যবিষয় এক আশ্চর্য গতিময়তা পায়। আবার রজনীকান্ত যখন বলে ওঠেন, ‘আমি একদম একা—একেবারে নিঃসঙ্গ—কেমন জানো? ধু-ধু করা দুপুরে
জ্বলন্ত মাঠে বাতাস যেমন একা'; তখন সংলাপের কাব্যধর্মিতায় এক নিঃস্ব মানুষের হাহাকার দর্শকমনকে স্পর্শ করে যায়। রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের দীর্ঘ সংলাপগুলিতে তাঁর অভিজ্ঞতা আর অনুভূতির প্রকাশে নাট্যকার সুকৌশলে ছেদ ও যতিচিহ্নের ব্যবহার করেন, যা চরিত্রের ভিতরকার টানাপোড়েনের
সার্থক প্রকাশ ঘটায়। আর এভাবেই নাট্যকারের সংলাপ রচনার মুনশিয়ানায় এক প্রতিভাবান শিল্পীর দ্বন্দ্ব-ক্ষোভ-ভালোবাসা-হতাশা ও আক্ষেপ দর্শকের চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে ওঠে।
প্রশ্ন:-'নানা রঙের দিন' নাটকটির নামকরণের তাৎপর্য আলোচনা করো।
উত্তর : উত্তরের জন্য 'নামকরণ' অংশটি দ্রষ্টব্য।
প্রশ্ন: "আমাদের দিন ফুরিয়েছে”–কে, কোন্ প্রসঙ্গে এই উক্তি করেছেন? বলার এই উপলব্ধির কারণ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর : বক্তা এবং প্রসঙ্গ : আলোচ্য উক্তিটি 'নানা রঙের দিন' নাটকে রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায় প্রম্পটার কালীনাথ সেনকে বলেছেন। থিয়েটারের মধ্যে অতীতের সোনালি দিনের স্মৃতিচারণা করছিলেন বৃদ্ধ অভিনেতা দিলদারের
পোশাক পরিহিত অবস্থায় রজনীকান্ত। আর সেইসব শুনতে শুনতে প্রম্পটার কালীনাথ যখন কেঁদে ওঠে তখন তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে জলভরা চোখে তিনি আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।
* দ্বিতীয় অংশের উত্তরের জন্য ১৫ নং প্রশ্নের উত্তরটি দ্রষ্টব্য।
প্রশ্ন: 'নানা রঙের দিন' একাঙ্ক নাটক হিসেবে কতখানি সার্থক আলোচনা করো।
উত্তর : একাঙ্ক নাটকের আঙ্গিক অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নানা রঙের দিন' একটি সার্থক একাঙ্ক নাটক। নাটকের একাঙ্ক, পাঙ্ক ইত্যাদি
বিভাজন হয়ে থাকে। সাধারণত স্বল্প পরিসরে সীমায়িত নাট্যঘটনা একটিমাত্র অঙ্কের মধ্যে বিন্যস্ত হলে তাকে একাঙ্ক নাটক বলা হয়। একাঙ্ক নাটকের কখনও দৃশ্য বিভাজন থাকে, আবার কখনও দৃশ্য বিভাজন ছাড়াই সমগ্র নাটকটি অভিনীত হয়। যেমন, 'নানা রঙের দিন'-এ কোনো দৃশ্য বিভাজন নেই। এখানে একটি রাতের মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ঘটনার সূত্রপাত-দ্বন্দ্বের
পরিস্থিতি-নাটকীয় উৎকণ্ঠা এবং নাটকীয় পরিণাম; এক মাত্রাহীন বাঞ্ছনা লাভ করেছে।
* একাঙ্ক নাটক হিসেবে সার্থকতা : পাঠ্য ‘নানা রঙের দিন' নাটকের মুখ্য চরিত্র পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের এক সময়কার খ্যাতিমান অভিনেতা বৃদ্ধ রজনীকান্ত চট্টোপাধ্যায়। তিনি মধ্যরাতে ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহের মধ্যের কালোদেয়ালের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে পান। তিনি টের পান এই সুদীর্ণ অভিনেতা জীবনে যৌবন, আদর্শ, শক্তি, সম্ভ্রম, প্রেম ও নারী—একে একে সব পার করে এসেছেন। যে অনায়াসে সাবলীলতায় চরিত্রগুলিকে নতুন রঙে ভরিয়ে তুলতে পারতেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই দক্ষতাও তিনি
হারিয়েছেন। চরিত্রকে ফুটিয়ে তোলার সামর্থ্য আর গলার কাজ তাঁর নষ্ট হয়ে গেছে। তাই তাঁর মনে হয়েছে, থিয়েটারের দেয়ালে কারও অদৃশ্য হাত অঙ্গারের কালো কালো জ্বলন্ত অক্ষরে লিখে দিয়ে গেছে অভিনেতা রজনী চাটুজ্জের প্রতিভার অপমৃত্যুর করুণ সংবাদ। এখন তিনি নায়কের চরিত্রের বদলে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেন। আর কয়েক বছর পর তাঁকে সেখানেও মানাবে না। কিন্তু যৌবনের দিনগুলির স্মৃতিচারণ তাঁকে উদ্বেল করে তোলে। তাঁর কণ্ঠে উঠে আসে 'রিজিয়া'-র বক্তিয়ার কিংবা 'সাজাহান'-এর
ঔরঙ্গজীবের সংলাপ। তিনি ঘোষণা করেন প্রতিভার অবিনাশী ঐশ্বর্যে কথা। তাঁর অসামান্য অভিনয়ে প্রম্পটার কালীনাথের চোখে জল আনে। তবে বৃদ্ধ রজনী চাটুজ্জের পরমুহূর্তেই মনে হয় শুধু ব্যক্তিগত আবেগ ও নাটকের প্রতি ভালোবাসা দিয়ে তো আর জীবনের পাত্রকে পূর্ণ করা যায় না। শিল্পীর জীবন থেকে প্রতিভা-সম্মান-খ্যাতি ও জৌলুষ সব একে একে
বিদায় নেয়। এভাবেই এক অভিনেতার শিল্পী হৃদয়ের আর্তি ও আর্তনাদ- চরিত্রচিত্রণে, একমুখী ঘটনার সংহত তীব্রতায় এবং তীক্ষ্ণ মর্মস্পর্শী সংলাপে ‘নানা রঙের দিন' নাটকটিকে একটি সার্থক ও প্রাণবন্ত একাঙ্ক নাটকে পরিণত
করে তুলেছে।
