একটি চড়ুই পাখি || হাতে-কলমে অনুশীলন প্রশ্নের উত্তর || অষ্টম শ্রেণি বাংলা।
![]() |
অষ্টম শ্রেণীর বাংলা
অধ্যায় ৯
একটি চড়ুই পাখি
তারাপদ রায়
কবি পরিচিতি। প্রসিদ্ধ কবি, ছোটোগল্পকার তারাপদ রায় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি
বাংলাদেশের বিন্দুবাসিনী হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। শিক্ষাগ্রহণের উদ্দেশ্যে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতায় আসেন
এবং সেন্ট্রাল কলকাতা কলেজ (বর্তমানে মৌলানা আজাদ কলেজ) থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হন। উত্তর ২৪ পরগনার হাবরায় একটি স্কুলে তারাপদ রায় কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'তোমার প্রতিমা' প্রকাশিত হয়। 'কাণ্ডজ্ঞান', 'বুদ্ধিশুদ্ধি', 'জ্ঞানগম্যি', 'ডোডো তাতাই পালাকাহিনি', 'বালিশ', 'চাড়াবাড়ি পোড়াবাড়ি' প্রভৃতি তাঁর স্মরণীয় গদ্যগ্রন্থ। তাঁর কবিতার বইয়ের মধ্যে 'নীল দিগন্তে এখন ম্যাজিক', "কোথায় যাচ্ছেন তারাপদবাবু', 'পাতা ও পাখিদের আলোচনা', 'দারিদ্র্যরেখা', 'জলের মতো কবিতা', 'দিন দিন খাই', 'ভালো আছো গরীব মানুষ' বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তারাপদ রায় ছিলেন 'কৃত্তিবাস' পত্রিকা-
গোষ্ঠীর একজন বিশিষ্ট সদস্য। সাহিত্যরচনায় পারদর্শিতার জন্য তিনি “শিরোমণি পুরস্কার' ও ‘কথা পুরস্কার' লাভ করেন। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ আগস্ট এই বিখ্যাত সাহিত্যিকের মৃত্যু হয়।
‘উৎস: ‘একটি চড়ুই পাখি' কবিতাটি তারাপদ রায়ের 'শ্রেষ্ঠ কবিতা' গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
সারসংক্ষেপ: কবি তারাপদ রায় ‘একটি চড়ুই পাখি' কবিতায় একটি ছোট্ট চড়ুইপাখিকে নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তা প্রকাশ করেছেন। একটি চালাক চড়ুইপাখি তার দল ছেড়ে এসে বাসা বেঁধেছে কবির ঘরে। সারাদিন ধরে সে এদিক-ওদিক থেকে বাসা তৈরির রসদ, খড়কুটো আর নানা খাদ্য জোগাড় করে। তারপর সন্ধ্যা নেমে এলেই সে কবির ঘরে ফিরে আসে। কখনও সে সাহসে ভর করে কবির কাছাকাছি এসে কৌতূহলী দুচোখ মেলে তাঁকে দেখতে থাকে। কবির মনে হয়, পাখিটি যেন এই চিন্তাই করে যে, তিনি চলে
গেলে যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা তারই হবে। স্বয়ং বিধাতাই তাকে এসব পেতে সাহায্য করবেন।
কখনও আবার পাখিটি কার্নিশে বসে তাচ্ছিল্যভরা মজার চাহনিতে কবির দিকে তাকায়। পাখিটির তাকানোর ভঙ্গি দেখে কবির মনে হয়, সে যেন এই ভাবটিই প্রকাশ করতে চায় যে, নিতান্ত মায়ায় জড়িয়ে পড়ার কারণেই সে 'এই ঘরে আছে। ইচ্ছা হলে যে-কোনো দিনই সে এপাড়ায়-ওপাড়ায় পালেদের বোসেদের বাড়ি চলে যেতে পারে। কবি কৃতার্থ, কারণ এত কিছু ভাবার পরও পাখিটি তাঁকে সেই ঘরটিতে একলা ফেলে রেখে অন্যত্র চলে যায় না। এ যেন তাঁর প্রতি পাখিটির দয়া বা করুণারই প্রকাশ। আসলে চড়ুইপাখিটি তার চঞ্চল উপস্থিতির মাধ্যমে কবির
একাকিত্বকে আরও বেশি প্রকট করে তুলেছে। পাখি ও মানুষ সকলেই প্রকৃতির সন্তান। পাখির ভাষা মানুষ বোঝে না। অথচ একাকিত্ব থেকে মুক্তি পেতে এই সামান্য চড়ুইপাখিটিই কবির অবলম্বন হয়ে ওঠে। এইভাবেই প্রকৃতির মধ্যে ঈশ্বরসৃষ্ট সকল প্রাণীর পারস্পরিক সহযোগিতার ভাবটি কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে।
নামকরণ: নামকরণের মধ্য দিয়েই কবি তাঁর পাঠকদের কবিতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারণা দিয়ে থাকেন। সেভাবেই তারাপদ রায় রচিত ‘একটি চড়ুই পাখি' কবিতার নামকরণটিও সরাসরি বিষয়বস্তুকে তুলে ধরেছে। কবির ঘরে একটি ছোটো, চতুর চড়ুইপাখি বাসা বেঁধেছে। সারাদিন এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে সন্ধ্যা নামার সময়ে সে বাসায় ফিরে আসে। তারপর কিচিরমিচির শব্দে ঘর ভরিয়ে তোলে। কখনও সে কবিকে খুব কাছ থেকেই কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখে, আবার কখনও-বা কার্নিশের
দূরত্ব থেকে চোখ মেলে দেখে। পাখিটি হয়তো ভাবে, ঘরের মালিকের অবর্তমানে ঘর-জানলা-দরজা, টেবিলের ফুলদানি, বই-খাতা সব কিছুর মালিক সে-ই হবে। বিধাতা সমস্ত কিছু তাকেই দেবেন। আবার এক-এক সময় কার্নিশে বসে তাচ্ছিল্যভরা মজার দৃষ্টিতে সে কবির দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন বোঝাতে চায়, নিতান্ত মায়ার বাঁধনেই এই বাজে ঘরে সে রয়েছে। ইচ্ছা করলে যে-কোনো দিনই সে চলে যেতে পারে। কবি মনে মনে ভাবেন, এত কিছুর পরেও যে পাখিটি অন্যত্র চলে যায় না, সেটা তার সৌজন্য ও দয়া। রাতের নির্জন ঘরে নিজেদের অস্তিত্বটুকু নিয়ে ছোটো চড়ুইপাখি এবং কবি একসঙ্গে থাকেন। সমগ্র কবিতাটিতে এভাবেই এক ছোট্ট চড়ুই পাখি ও তার কার্যকলাপকে কেন্দ্র করে কবির অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে কবির সমস্ত চিন্তা, কল্পনা, অনুভূতি চড়ুইপাখিকে নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে। ফলে, খুব সংগত কারণেই কবিতাটির নামকরণ যথাযথ ও সার্থক হয়েছে।
হাতেকলমে অনুশীলন প্রশ্নের উত্তর
১. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।
১.১ তারাপদ রায় কত খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ?
উত্তর: বিশিষ্ট কবি ও রসরচনাকার তারাপদ রায় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন।
১.২ তাঁর রচিত দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম লেখো।
উত্তর: কবি তারাপদ রায় রচিত দুটি কাব্যগ্রন্থের নাম হল— 'তোমার প্রতিমা' এবং 'জলের মতো কবিতা'।
২.নীচের প্রশ্নগুলির একটি বাক্যে উত্তর লেখো ।
২.১ কবিতায় চড়ুইপাখিটিকে কোথায় বাসা বাঁধতে দেখা যায় ?
উত্তর: কবি তারাপদ রায়ের 'একটি চড়ুই পাখি' কবিতায় চতুর চড়ুইপাখিটিকে কবির ঘরে বাসা বাঁধতে দেখা যায় ৷
২.২ চড়ুইপাখি এখান-সেখান থেকে কী সংগ্রহ করে আনে?
উত্তর: ‘একটি চড়ুই পাখি' কবিতায় চড়ুই পাখিটি সারাদিন ঘুরে ঘুরে এখান- সেখান থেকে খড়কুটো, ধান ইত্যাদি সংগ্রহ করে আনে।
২,৩ কবির ঘরে কোন্ কোন্ জিনিস চড়ুই পাখিটির চোখে পড়ে?
উত্তর: কবি তারাপদ রায় রচিত 'একটি চড়ুই পাখি' কবিতায় কবির ঘরের জানালা-দরজা, টেবিলে রাখা ফুলদানি, বই-খাতা—এসবই চড়ুইপাখিটির চোখে পড়ে।
২.৪ ইচ্ছে হলেই চড়ুইপাখি কোথায় চলে যেতে পারে?
উত্তর: ‘একটি চড়ুই পাখি' কবিতার চড়ুইপাখিটি ইচ্ছে হলেই এপাড়ার- ওপাড়ার পালেদের বা বোসেদের বাড়িতে চলে যেতে পারে।
৩.নীচের প্রশ্নগুলি কয়েকটি বাক্যে উত্তর লেখো।
৩.১ “চতুর চড়ুই ঘুরে ফিরে আমার ঘরেই/বাসা বাঁধে”—চড়ুইপাখিকে এখানে 'চতুর' বলা হল কেন ?
উত্তর: আলোচ্য অংশটি একালের বিশিষ্ট কবি তারাপদ রায়ের লেখা ‘একটি চড়ুই পাখি” কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে।
চতুর চড়ুই: এখানে কবির ঘরে বাসা বাঁধা চড়ুইপাখিটিকে 'চতুর' বলা হয়েছে। 'চতুর' শব্দের অর্থ হল চালাক', 'কুশল' বা 'কর্মদক্ষ'। চড়ুইপাখিটি একাকী কবির নির্জন ঘরটিকে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছে। শুধু
তা-ই নয়, কবির ধারণা যে কবির অনুপস্থিতিতে ওই ঘরের মালিকানাও ভোগ করতে চায়। এ কারণেই কবি তাকে 'চতুর' আখ্যা দিয়েছেন।
৩.২ কবিতায় ব্যবহৃত চিত্রকল্পগুলি দৃষ্টান্ত-সহ আলোচনা করো ।
উত্তর: কথামুখ: কবি তারাপদ রায় রচিত ‘একটি চড়ুই পাখি' কবিতায় কবি তাঁরই ঘরে বাসা বাঁধা একটি চড়ুইপাখির প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন।
কবির বর্ণনাশৈলীর গুণে এই ছোটো পাখিটির কার্যকলাপ উপভোগ হয়ে উঠেছে।
চিত্রকল্পের ধারণা: কবিতায় বা গদ্যে শব্দের মাধ্যমে ছবি ফুটিয়ে।তোলাকেই বলা হয় চিত্রকল্প বা imagery। আলোচ্য কবিতায় “অন্ধকার ঠোঁটে নিয়ে সন্ধ্যা ফেরে যেই / সে'ও ফেরে”–পঙ্ক্তিটিতে নিঃশব্দে সন্ধ্যা নেমে আসার মুহূর্তের পাশাপাশি চড়ুইপাখিটির নিঃশব্দে বাসায় ফিরে আসার ঘটনাটিকেও চিত্রের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
চিত্রকল্পের প্রয়োগ : ছড়ার শব্দের টুকরো বলতে ছোট্ট পাখিটির থেমে থেমে ডেকে চলাকে বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়াও “কৌতূহলী দুই চোখ মেলে/অবাক দৃষ্টিতে” –এর মধ্য দিয়ে পাখিটির চেয়ে থাকার বিষয়টি বোঝানো হয়েছে।
“আবার কার্নিশে বসে চাহনিতে” পঙক্তিটিতে মজার ও তাচ্ছিল্যের ভাব জাগিয়ে তোলার বিবরণেও বর্ণময় চিত্রকল্পেরই ব্যবহার লক্ষ করা যায়। 'রাত্রির নির্জন ঘরে" বলতে কবির নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্বকে বোঝানো হয়েছে। কবিতার কখনও পাখিটির বর্ণনায়, কখনও-বা তার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় কবি টুকরো টুকরো ব্যপ্তনাময় ছবি এঁকেছেন। আবার কখনও পাখির ভাবনাচিন্তার কৌশল অথবা মানসিক দ্বন্দ্বের ভাষারূপও দিয়েছেন চিত্রকল্পের সাহায্যে।
৩. “হয়তো ভাবে...”— চড়ুইপাখি কী ভাবে বলে কবি মনে করেন?
উত্তর: শুরুর কথা: কবি তারাপদ রায় ‘একটি চড়ুই পাখি' কবিতায় তাঁর ঘরে বাসা বেঁধেছে, এমন একটি চড়ুইপাখির কথা বর্ণনা করেছেন।
কবির ভাবনায় চড়ুই: কবি মনে করেন, তাঁর এই নিরুপদ্রব, শান্ত, আড়ম্বরশূন্য গৃহস্থালির রূপ দেখে চড়ুইপাখিটি অনেক কিছু কল্পনা করে।
সে হয়তো ভাবে, কবি যখন এই গৃহে আর থাকবেন না তখন এই ঘর, জানলা দরজা, টেবিলে রাখা ফুলদানি, বই খাতা প্রভৃতি সমস্ত স্থাবর- অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা বিধাতা তাকেই দান করবেন।
চড়ুইয়ের আচরণ, চতুর চড়ুইপাখিটি যেভাবে কবির নির্জন বাসস্থানে নিজের আশ্রয়টি সুনিশ্চিত করেছে এবং নিশ্চিন্তমনে যেভাবে ঘরের ভিতরে বিচরণ করছে, তাতে তার মনে এমন ভাবনার উদয় হওয়া অসম্ভব।
৩.৪ "আবার কার্নিশে বসে চাহনিতে তাচ্ছিল্য মজার...."-- তাচ্ছিল্যভরা মজার চাহনিতে তাকিয়ে চড়ুই কী ভাবে ?
উত্তর৷ ভূমিকা। কবি তারাপদ রায়ের লেখা 'একটি চড়ুই পাখি' কবিতা থেকে আলোচ্য উদ্ধৃতিটি নেওয়া হয়েছে।
চড়ুইটির কার্যকলাপ; কবির ঘরে বাসা বাঁধা একটি ছোট চড়ুইপাখি তার চলে চলাফেরায়, বিচিত্র শব্দে, শরীরের নানান ভঙ্গিতে কবি হৃদয় অধিকার করেছে এবং তাঁর শূন্য ঘরকে ভরিয়ে তুলেছে।
পাখিটির মনোভাব: নিতান্ত কৌতুকপ্রবণ হয়েই সে যেন ঘরের কার্নিশে বসে তাচ্ছিল্যভরা
মজার চাহনিতে কবির দিকে তাকায়। কবির মনে হয় পাখিটি যেন তাঁকে বোঝাতে চায় যে নিতান্ত মায়ার শরীর বলেই সে কবির বাড়িতে রয়েছে।
এই ঘরবাড়ি ও কবির উপর মায়া পড়ে গেছে বলেই পাখিটি এপাড়ায়- ওপাড়ায় পালেদের, বোসেদের বাড়িতে চলে না গিয়ে একাকী কবির সঙ্গী হয়ে সেই বাজে ঘরটিতে বসবাস করছে।
৩.৫ চড়ুইপাখিকে কেন্দ্র করে কবির ভাবনা কীভাবে আবর্তিত হয়েছে, তা কবিতা অনুসরণে আলোচনা করো ।
উত্তর: শুরুর কথা: তারাপদ রায় রচিত 'একটি চড়ুই পাখি' কবিতায় কবির ঘরে বাসা বাঁধা একটি চড়ুইপাখিকে কেন্দ্র করে কবির ভাবনা বিস্তারলাভ করেছে। সারাদিন খাবার জোগাড়ের বা বাসা বানানোর লক্ষ্যে এখানে-সেখানে ঘুরে চড়ুইপাখিটি ধান কিংবা খড়কুটো সংগ্রহ করে বেড়ায় ।ৎআবার সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে সে ফিরে আসে কবির ঘরে, তার নিরাপদ আশ্রয়ে।
কবির সঙ্গী : নির্জন ঘরে সে কবির একমাত্র সঙ্গী হয়ে ওঠে। একই সঙ্গে পাখিটি কবির সমস্ত ভাবনাচিন্তাকে যেন অধিকার করে নেয়।
নিঃশব্দ ঘরটিকে কিচিরমিচির শব্দে ভরিয়ে তোলে ছোট্ট চড়ুই। পাখিটি কখনও আবার কৌতূহলী দুই চোখ মেলে অবাক দৃষ্টিতে কবির দিকে তাকিয়ে থাকে। চড়ুইয়ের ভাবনা: ছোট্ট চড়ুই পাখিটি মনে মনে যেন ভাবে যে, মানুষটির অবর্তমানে বিধাতা তাকেই সেই ঘর, জানালা-দরজা, টেবিলের ফুলদানি, বই-খাতা সব দান করবেন। পাখিটির কর্মকান্ড : আবার কখনও কবি ওই পাখিটিকে কার্নিশে বসে থাকতে দেখেন। সেখানে বসে বসে চড়ুইপাখিটি তাচ্ছিল্যভরা মজার চাহনিতে কবির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ভাবটা দেখে মনে হয় যে, নিতান্ত মায়ার শরীর বলেই এই বাজে ঘরটিতে সে বাস করছে। নয়তো
ইচ্ছে করলেই সে এপাড়ার ওপাড়ার পালেদের, বোসেদের বাড়ি চলে যেতে পারে। চড়ুইটির মা। এরকম মনে হওয়া সত্ত্বেও পাখিটি যে কবিকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় না, সেই ব্যাপারটিকে তাঁর চড়ুই পাখিটিরই মহত্ত্ব এবং দয়া বলে মনে হয়। রাতে কবির নির্জন ঘরে একমাত্র সঙ্গী হিসেবে বিরাজ করে চড়ুইপাখিটি। কবির একাকিত্বের প্রতি সে যেন প্রবল সমানুভূতিশীল হয়ে ওঠে। এভাবেই গোটা কবিতাজুড়ে চড়ুইকে নিয়ে কবির ভাবনা আবর্তিত হয়েছে।
৩.৬ “তবুও যায় না চলে এতটুকু দয়া করে পাখি”—পঙ্কিটিতে কবি- মানসিকতার কীরূপ প্রতিফলন লক্ষ করা যায় ?
উত্তর: আলোচ্য পতিটি কবি তারাপদ রায়ের লেখা 'একটি চড়ুই পাখি কবিতার অন্তর্গত। এখানে কবির প্রতি তাঁর ঘরে বাসা বাঁধা অতিক্ষুদ্র একটি চড়ুইপাখির অপূর্ব সমানুভূতির প্রতিফলন ঘটেছে। ছোট্ট চড়ুইপাখিটি তার চলাফেরায় স্বাধীন। সে যে-কোনো জায়গাতেই উড়ে চলে যেতে পারে, অন্য কোথাও গড়ে তুলতে পারে তার আশ্রয়। তবুও সে কবির নির্জন ঘরটিতে পরম স্বাচ্ছন্দ্যে, নিশ্চিন্তে, আলাপে- কৌতুকে প্রসন্নতায় বিরাজ করে। এই বিষয়টিকে কবি তাঁর প্রতি পাখিটির 'দয়া' হিসেবেই দেখেছেন। এই পাখিটি কবির ঘরে থাকায় একাকিত্বের মধ্যেও কবি তাঁর এক সঙ্গীকে খুঁজে পেয়েছেন। তাঁর সব চিন্তাভাবনা আর কাজের মধ্যে সেই পাখিটির উপস্থিতির ছাপ লক্ষ করা যায়। কবির আশঙ্কা, ইচ্ছের ঝোঁকে পাখিটি এপাড়ার ওপাড়ার পালেদের, বোসেদের বাড়ি চলে গেলে কবি তাঁর এই সঙ্গীটিকে হারাবেন এবং নিঃসঙ্গ হয়ে পড়বেন। চড়ুইপাখিটি ক্ষুদ্র হলেও তার প্রতি কবির মনোভাব, তাঁর সঙ্গ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা এবং একাকিত্ব দূর করার অনুভূতিকেই কবি আলোচ্য কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
৩.৭ ছোট্ট চড়ুইপাখির জীবনবৃত্ত কীভাবে কবিতার ক্ষুদ্র পরিসরে আঁকা।হয়েছে তার পরিচয় দাও।
উত্তর: পাখির জীবনচিত্র : একটি ছোটো পাখির জীবনবৃত্তই কবি তারাপদ রায়ের লেখা ‘একটি চড়ুই পাখি’ কবিতায় অঙ্কিত হয়েছে। নিজের বাসস্থান আর খাবারের প্রয়োজনে এ-বাড়ির খড়কুটো, ও-বাড়ির ধান জোগাড় করে এনে চড়ুইপাখিটি কবির নির্জন ঘরে বাসা বাঁধে। চড়ুইয়ের দৈনন্দিন কার্যাবলি : সন্ধ্যায় সে ঘরে ফিরে একান্তে কবির সঙ্গে দৃষ্টি আর ভাবের বিনিময় ঘটায়। তার কিচিমিচি শব্দে ঘরের নির্জনতা ভাঙে। আবার কখনও পাখিটিকে কার্নিশের উপর থেকে মজার চাহনিতে কবির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায়। তাকে দেখে কবির মনে হয় পাখিটি যেন তাঁর অবর্তমানে বিধাতার কৃপায় সব সম্পত্তির মালিক হওয়ার কথা ভাবে।
পাখির হাবভাব : পাখিটি যেন হাবেভাবে বুঝিয়ে দিতে চায় যে, নিতান্ত মায়ার শরীর বলেই সে এইরকম বাজে ঘরে রয়ে গেছে। অন্যত্র চলে যাওয়ার স্বাধীনতা থাকলেও সে চলে যায়নি। রাতের নির্জন ঘরেও কবি ও চড়ুইটি শান্তিতে একসঙ্গে বসবাস করেন। এইভাবেই চড়ুইয়ের প্রতিদিনের জীবনকে কবিতায় তুলে ধরেছেন কবি।
৩.৮ “কৌতূহলী দুই চোখ মেলে/ অবাক দৃষ্টিতে দেখে”—চড়ুইপাখির চোখ ‘কৌতূহলী’ কেন? তার চোখে কবির সংসারের কোন্ চালচিত্র ধরা পড়ে?
উত্তর: কৌতূহলী হওয়ার কারণ: আলোচ্য পঙ্ক্তিটি কবি তারাপদ রায়ের লেখা ‘একটি চড়ুই পাখি' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। কবির ঘরে একটি 'চতুর' চড়ুইপাখি বাসা বেঁধেছে। সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে ঠিক সন্ধ্যা নামার মুহুর্তেই সে তার বাসায় ফিরে আসে। সংগ্রহ করে আনে এ বাড়ির বড়কুটো ও বাড়ির ধান। কবির দিক থেকে কোনো বাধা না পাওয়ার কারণেই তার এতটা সাহস এবং স্বাচ্ছন্দ্য। কবির সঙ্গে থাকতে থাকতে
পাখিটি যেন ক্রমশ তাঁর সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। ঘরটিতে মাত্র একজন লোকের উপস্থিতি লক্ষ করে, নিশ্চিন্তে আর নিরুপদ্রবে সে
সেখানে থাকতে পারে। তার বিশ্বাস জন্মায় যে, কবি চলে গেলে কবির ঘরে যা জিনিসপত্র আছে, সেসবের মালিক সেই হবে। সে কৌতূহলী চোখে
দেখতে থাকে ঘরে কী কী জিনিস রয়েছে, যা একদিন তার হবে। চতুর চড়ুইপাখিটি তাই তার দু-চোখে কৌতূহল জাগিয়ে কবির ঘরের চারপাশ দেখতে থাকে।
→ কবির সংসারের চালচিত্র। তার চোখে কবির ঘর, ঘরের জানালা- দরজা, টেবিলের ফুলদানি, বই-খাতা ইত্যাদি ধরা পড়ে। সেই সঙ্গেই কবির
নির্জন ঘর নিঃসঙ্গ জীবনের ছবিটিও ফুটে উঠেছে। পাখিটি যেন ভাবে, ঘরের মানুষটি চলে গেলে বিধাতার ইচ্ছায় সে-সবকিছুই তার হয়ে যাবে।
৩.৯ "রাত্রির নির্জন ঘরে আমি আর চড়ুই একাকী।”—পঙ্কিটিতে।'একাকী' শব্দটি প্রয়োগের সার্থকতা বুঝিয়ে দাও ।
উত্তর: 'একাকী' শব্দটির প্রয়োগের সার্থকতা: ‘একাকী' শব্দের অর্থ হল যার কেউ নেই, যে নিঃসঙ্গ, অসহায়, একক বা একলা। কবি তারাপদ
রায়ের লেখা 'একটি চড়ুই পাখি' কবিতায় 'একাকী' শব্দটি ক্রিয়া- বিশেষণরূপে 'সঙ্গীহীন' অবস্থা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে। শব্দটির মাধ্যমে কবির অসহায়তা এবং একাকিত্ব প্রকাশিত হয়েছে। ঘর গৃহস্থালির সেই বর্ণনাতেই তাঁর নিঃসঙ্গতা ধরা পড়েছে। চড়ুই পাখির মতো অন্য জীব, সঙ্গী হিসেবে সম্পূর্ণভাবে তাঁর একাকিত্বের ভাগীদার হয়ে উঠতে পারে না। বিচ্ছিন্ন দুটি পৃথক সত্তা হিসেবে সেই ঘরে কবি এবং সেই চড়ুইপাখিটি বসবাস করে।
৩.১০ ‘একটি চড়ুই পাখি' ছাড়া কবিতাটির অন্য কোনো নামকরণ করো কেন তুমি এমন নাম দিতে চাও, তা বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: কবিতাটির পৃথক নাম: 'একটি চড়ুই পাখি' ছাড়া কবিতাটির যে নামকরণটি আমি করতে চাই, তা হল 'আমি, আমার ঘর ও একটি চড়ুই”।
> কবিতাটির এমন নাম দিতে চাওয়ার কারণ ‘একটি চড়ুই পাখি' শীর্ষক নামটিতে কবির উপস্থিতি প্রধান নয়। কবির ঘরে বাসা বেঁধেছে যে নির্দিষ্ট পাখিটি, তাকে নিয়েই কবিতাটি রচিত। কবির ঘরের নির্জনতা ও নিরাপত্তা
চড়ুইপাখিটিকে নির্ভয়ে আর স্বচ্ছন্দে বিচরণের সুযোগ করে দিয়েছে।
ভিন্ন নামের কারণ: স্থানের গুরুত্ব কবিতাটির নামকরণের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। অতএব, নামকরণের ক্ষেত্রে কবি, তাঁর ঘর এবং সেই
চড়ুইপাখি—এই তিনেরই উল্লেখ থাকা প্রয়োজন বলে আমি এই নামকরণ করতে চাই।
৪.নীচের শব্দগুলির প্রকৃতি-প্রত্যয় নির্ণয় করো—সন্ধ্যা, কৌতূহলী, দৃষ্টি।
উত্তর: সন্ধ্যা = সম্ + ধ্যৈ + যঞ্চ + আ
দৃষ্টি = দৃশ্ + তি
কৌতূহলী = কুতূহল + অ + ঈ
৫. নির্দেশ অনুসারে উত্তর দাও ।
৫.১ অন্ধকার ঠোটে নিয়ে সন্ধ্যা ফেরে যেই সে'ও ফেরে। (সরল বাক্যে)
উত্তর: অন্ধকার ঠোটে নিয়ে সন্ধ্যার সঙ্গে সেও ফেরে।
৫.২ কখনো সে কাছাকাছি কৌতূহলী দুই চোখ মেলে অবাক দৃষ্টিতে দেখে। (নিম্নরেখাঙ্কিত শব্দের বিশেষ্যের রূপ লিখে বাক্যটি আবার লেখো।)
উত্তর: কৌতূহলী (বিণ) = কৌতূহল (বি)
কখনো সে কাছাকাছি কৌতূহলভরা দুই চোখ মেলে অবাক দৃষ্টিতে দেখে।
৫.৩ আমাকেই দেবেন বিধাতা ।।(না-সূচক বাক্যে)
উত্তর: বিধাতা আমাকে ছাড়া আর কাউকেই দেবেন না।
৫.৪ এই বাজে ঘরে আছি নিতান্ত মায়ার শরীর আমার তাই। (জটিল বাক্যে)
উত্তর: যেহেতু আমার নিতান্তই মায়ার শরীর সেহেতু এই বাজে ঘরে আছি।
৫.৫ ইচ্ছে হলে আজই যেতে পারি এপাড়ায় ওপাড়ায় পালেদের বোসেদের বাড়ি। (জটিল বাকো)
উত্তর: যদি ইচ্ছে হয়, তবে আজই যেতে পারি এপাড়ায় ওপাড়ায় পালেদের বোসেদের বাড়ি।
নীচের শব্দগুলির ধ্বনিতাত্ত্বিক বিচার করো—চড়ুই, ধান,য়চোখ, জানলা, দোর, ইচ্ছে, পাখি।
উত্তর: চড়ুই—চড়াই > চড়ুই (স্বরসংগতি)
ধান-ধান্য > ধান (ব্যঞ্জনলোপ)
চোখ-চক্ষু > চোখ (ধ্বনিলোপ)
জানলা-জানালা > জানলা (ধ্বনিলোপ)
দোর-দ্বার > দুয়ার > দোর (স্বরাগম)
ইচ্ছে—ইচ্ছা > ইচ্ছে (স্বরসংগতি)
পাখি-পক্ষী > পথখি পাখি (সমীকরণ ব্যঞ্জনলোপ, ক্ষতিপূরণ,দীঘীভবন)
৭.'চোখ' শব্দটিকে পৃথক পৃথক অর্থে ব্যবহার করে বাক্য রচনা করো।
উত্তর: * চোখ (ইন্দ্রিয় অর্থে) অনুপমবাবুর চোখ খারাপ হওয়ার পর থেকে সন্ধেবেলা রাস্তায় বেরোতে ভয় পান।
চোখ (সরলতা অর্থে) দুষ্ট লোকের চালাকি অনেক সময় সাদা চোখে
ধরা পড়ে না।
চোখ (দূরদর্শিতা অর্থে) - লোক চেনার মতো চোখ ক'জনেরই বা থাকে।
চোখ (সর্বদা নজরে রাখা অর্থে) – যা দিনকাল, তাতে সন্দেহভাজনব্যক্তিকে চোখে চোখে রাখাই ভালো।
চোখ (রাগ বা মেজাজ দেখানো অর্থে) আমায় চোখ দেখিও না, তোমার চালাকি আমি ধরে ফেলেছি।
