পথ চলতি || হাতে কলমে অনুশীলন প্রশ্নের উত্তর || অষ্টম শ্রেণি বাংলা
![]() |
অষ্টম শ্রেণি বাংলা
অধ্যায় ৮
পথচলতি
শুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
লেখক পরিচিতি: প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক, বহুভাষাবিদ, প্রাবন্ধিক তথা অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে হাওড়া জেলার শিবপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হরিদাস চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজদের সওদাগরি অফিসের কেরানি। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র সুনীতিকুমার ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মতিলাল শীল ফ্রি স্কুল থেকে এনট্রান্স পাস করেন। এরপর
স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে এফএ, প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বিএ এবং এমএ পাস করেন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে কিছুকাল চাকরি করার পর ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্বনিবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে যান। ওই সময় তিনি বিভিন্ন ভাষা নিয়ে প্রচুর কাজ করেছেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে তিনি খয়রা' অধ্যাপকরূপে কাজে যোগ দেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের জাতীয় অধ্যাপক হন। তাঁর লেখা একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল 'The Origin and Development of the Bengali Language'। বাংলা ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে তিনি অজস্র প্রবন্ধ রচনা করেছেন। এ বিষয়ে রচিত একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল 'বাঙ্গালা ভাষাতত্ত্বের ভূমিকা'। ছাড়াও তিনি নানান বিষয়ের ওপর বই লিখেছেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল 'রবীন্দ্রসঙ্গমে', 'দ্বীপময় ভারত', 'শ্যামদেশ', 'পশ্চিমের যাত্রী', "ইউরোপ ভ্রমণ', 'জাতি সংস্কৃতি সাহিত্য', 'ভারতের ভাষা ও ভাষা সমস্যা', 'ভারত সংস্কৃতি', 'মনীষীস্মরণে', 'সংস্কৃতি কী' প্রভৃতি। ‘জীবনকথা” নামে রচিত তাঁর আত্মজীবনীটি বাংলা সাহিত্যের এক অন্যতম সম্পদ। ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জীবনাবসান ঘটে।
উৎস: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত 'পথচলতি’ রচনাংশটি তাঁর ‘পথচলতি' গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
বিষয়সংক্ষেপ: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘পথচলতি’ শীর্ষক গদ্যাংশে গয়ায় অবস্থিত তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে দেহরাদুন এক্সপ্রেসে চড়ে।কলকাতায় ফেরার ঘটনা বর্ণনা করেছেন। সেটি সম্ভবত ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে শীতকালের ঘটনা। স্টেশনে পৌঁছে লেখক দেখলেন, ট্রেন ঠিক সময়ে এলেও তাতে অসম্ভব ভিড়। তাঁর কাছে ছিল মধ্যম শ্রেণির রিটার্ন টিকিটের ফিরতি অংশ। সমস্ত ট্রেনটাকে একবার ঘুরে দেখার জন্য তিনি ইঞ্জিনের দিকে এগোলেন। সেখানে দেখলেন একটি বড়ো তৃতীয় শ্রেণির বগির কাছে একেবারেই লোকজনের ভিড় নেই। কাছে গিয়ে দেখলেন কয়েকজন কাবুলিওয়ালা সেটি দখল করে রয়েছে। সাধারণ যাত্রী, কর্তব্যরত রেলের।কর্মচারী বা পুলিশ কেউই তাদের হুংকার আর জবরদস্তির জন্য সেদিকে ঘেঁষছেন না। ফারসি ভাষায় কিছু কথাবার্তা বলতে পারেন, কেবল এই সাহসে ভর করে লেখক তাদের কামরাটি খুলে ভিতরে ঢুকতে গেলেন। তখনই
কাবুলিওয়ালাদের পশতু ভাষায় করা নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হলেন তিনি। তিনি ওইসব প্রশ্নের উত্তর দিলেন ফারসিতে। ফারসি আফগানিস্তানের
শিক্ষিতজনের ভাষা, উচ্চ ও ভদ্রসমাজের ভাষা, সরকারি ভাষা। সেই ফারসি ভাষা না জানার জন্য তাদের সঙ্গে সামান্য উপহাস আর তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে কথা বলেন লেখক। গাড়ির ভেতরের একজন যুবক বলে যে, সে ফারসি জানে। এরপর সে লেখকের কাছে জানতে চায়, তিনি কী চান। তখন লেখক তাকে জানান, তিনি কলকাতায় যাবেন, তাঁকে ওই কামরায় একটু জায়গা দেওয়া হোক। তারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। এরপর লেখক ফারসি জানেন বলে তাঁকে সম্মানের সাথে দেখতে থাকে সকলে। এমন সময় ইশারায় দলের অনুমতি পেয়ে সেই যুবক লেখককে ভিতরে আসতে বলে। ভিতরে এসে লেখক অবাক হয়ে লক্ষ করেন, তারা তাঁকে পুরো একটি বেও ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দিয়েছে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তপ্রদেশ আর ইংরেজ অধীনস্থ পাঠান-উপজাতি অঞ্চলের এই মানুষগুলির সঙ্গে এরপর লেখক হিন্দুস্থানি আর বাংলায় বেশিরভাগ কথাবার্তা বলতে বলতে এগিয়ে চললেন কলকাতার দিকে। সেই
ষোলো জন কাবুলিওয়ালার মধ্যে আগা-সাহেবের কথা লেখক বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের বরিশালের পটুয়াখালি বন্দরকে কেন্দ্র করে আগা-সাহেবের ব্যাবসা। তিনি শীতবস্ত্র আর হিং বিক্রি করতেন। পাশাপাশি চাষিদের টাকাও ধার দিতেন। এরপর দীর্ঘ রেলযাত্রায় সময় কাটাবার উদ্দেশ্যে লেখক পাঠানদের পশুতু ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি খুশ-হাল-খাঁ খট্টকের গজল শোনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। কাবুলিওয়ালাদের কাছ থেকে তিনি তা শুনলেনও। এ ছাড়াও আদম
খাঁ আর দুরখানির মহব্বতের কিসসাও তাঁকে শোনাল কাবুলিরা। এইভাবে সেই কামরাটিতে যেন পশতু-সাহিত্যগোষ্ঠী বা সম্মেলন ঘটে গেল। লেখক তাঁর কথাবার্তার মাধ্যমে কাবুলিওয়ালাদের সম্ভ্রম আদায় করে নিলেন। রাতে গভীর ঘুমের পর ভোরে উঠেই লেখক কাবুলিওয়ালাদের রোজার প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তে দেখলেন। পটুয়াখালির বৃদ্ধ আগা খাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে লেখক দেখলেন, গাড়ি আসানসোলে এসে পড়ল। অবশেষে যথাসময়ে ট্রেন কলকাতা এসে পৌঁছোল ৷ ঘটনাটির পর বহুদিন পেরিয়ে গেলেও লেখক তাঁর সেই সহযাত্রীদের কথা ভুলতে পারেননি। খুঁটিনাটি সব কিছু বর্ণনার গুণে, বৈঠকি ঢংয়ে গল্পগুলি
তুলে ধরার মধ্য দিয়ে রচনাংশটি অত্যন্ত মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছে।
নামকরণ: রচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে পাঠকের ধারণা তৈরি হয় নামের মধ্য দিয়েই। নামকরণ বিভিন্ন দিক।থেকে হতে পারে। কখনও তা হয় চরিত্র অনুসারে, কখনও বা হয় ব্যঞ্জনাধর্মী।
আলোচ্য গল্পে লেখকের নামকরণ কতটা সফল হয়েছে, তা-ই আমাদের বিচার্য বিষয় । প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একবার গয়ায় অবস্থিত তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে ট্রেনে করে কলকাতায় ফিরছিলেন। সেই রেলযাত্রার কাহিনি তিনি পাঠ্যাংশে তুলে ধরেছেন। নিছক পথচলার বিবরণ হিসেবেই ‘পথচলতি' নামটি গ্রহণযোগ্য। এই রেলযাত্রাটি লেখকের কাছে স্মরণীয় হয়ে উঠেছে কাবুলিওয়ালাদের সহযাত্রী হওয়ার দুর্লভ অভিজ্ঞতার কারণে। তাই আর পাঁচটা ভ্রমণকাহিনির সঙ্গে এর কোনো মিলই খুঁজে পাওয়া যাবে না। একজন ভদ্রলোকের পাঠান দেশে পাঠানদের মধ্যে দিন কাটানোর অভিজ্ঞতার কথা লেখক সম্ভবত 'প্রবর্তক' পত্রিকায় পড়েছিলেন বলে জানিয়েছেন। কিন্তু কাবুলিওয়ালাদের মধ্যে সময় কাটানোর নিজস্ব অভিজ্ঞতা তাঁর এই প্রথম। দেহরাদুন এক্সপ্রেসে চড়ে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের এক শীতের রাতে কলকাতা ফেরার সময়ে ষোলো জন কাবুলিওয়ালার মধ্যে তিনিই ছিলেন একা বাঙালি। কীভাবে যে তিনি তাদের কাছে নিতান্ত গুরুত্বহীন।থেকে পরম আদরণীয়, শ্রদ্ধেয় ও ‘আলেম' হয়ে উঠেছিলেন—সেই বিবরণই শুনিয়েছেন লেখক। সেইসঙ্গে আলোচনা করেছেন বরিশালের এক ব্যবসায়ী কাবুলিওয়ালার কথা, পশতু কবি খুশ হাল খাঁ খটক, কিংবা আদম খাঁ- দুরখানির কিসসার প্রসঙ্গ। এইভাবে সেই ট্রেনের কামরাটিতে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ আর ইংরেজ অধীনস্থ পাঠান উপজাতি অঞ্চলের কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে নিয়ে লেখক যেন পশতু সাহিত্য সম্মেলনের এক পরিবেশ গড়ে তুলেছিলেন। গভীর অন্তরঙ্গতায় কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তার পাশাপাশি তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির কথাও এসেছে আলোচ্য রচনায়। আর এ সমস্ত ঘটেছে একত্রে পথচলার সূত্রেই। সারাজীবনেও তিনি সেই ট্রেনযাত্রার কথা ভোলেননি। রচনাটির সমস্ত ঘটনাই পথে ঘটেছে বলে রচনাটির নামকরণটি সার্থক ও যথাযথ হয়েছে বলা যায়।
'হাতেকলমে' অনুশীলন প্রশ্নের উত্তর
১.নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও ।
১.১ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীর নাম কী ?
উত্তর: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের আত্মজীবনীটির নাম ‘জীবনকথা’।
১.২ ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে কোন গ্রন্থ রচনার জন্য তিনি স্মরণীয় হয়ে আছেন ?
উত্তর: The Origin and Development of the Bengali Language' নামের ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থ রচনার জন্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় স্মরণীয় হয়ে আছেন।
২. নীচের প্রশ্নগুলির একটি বাক্যে উত্তর দাও ।
২.১ লেখকের কোন্ ট্রেন ধরার কথা ছিল ?
উত্তর: লেখকের গয়া স্টেশন থেকে ‘দেহরাদুন এক্সপ্রেস' ট্রেন ধরার কথা ছিল।
২.২ একটা তৃতীয় শ্রেণির বগির কাছে একেবারেই লোকের ভিড় নেই কেন ?
উত্তর: একটা তৃতীয় শ্রেণির বগির কাছে একেবারেই লোকের ভিড় ছিল না, কারণ, ট্রেনের সেই অংশটি ছিল কাবুলিওয়ালাদের দখলে।
২,৩ পাঠানদের মাতৃভাষা কী ?
উত্তর: পাঠানদের মাতৃভাষা হল ‘পশতু’।
২.৪ বৃদ্ধ পাঠানের ডেরা বাংলাদেশের কোথায় ছিল?
উত্তর: বৃদ্ধ পাঠানের ডেরা ছিল বাংলাদেশের বরিশাল অঞ্চলের পটুয়াখালি বন্দরে ।
২.৫ বুশ-হাল খাঁ খট্টক কে ছিলেন?
উত্তর: বুশ-হাল খাঁ খটক ছিলেন আওরঙ্গজেবের সমসাময়িক এবং পাঠানদের পশতু ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি।
২.৬ আদম খাঁ ও দূরখানির কিসসার কাহিনি কেমন ?
উত্তর: আদম খাঁ ও দুরখানির মহব্বতের কিসসার কাহিনি হল 'দিল-ভাঙা কাহিনি' অর্থাৎ বেদনার আখ্যান।
২.৭ এই পাঠ্যে কোন্ বাংলা মাসিকপত্রের উল্লেখ আছে?
উত্তর: এই পাঠ্যে ‘প্রবর্তক' নামে বাংলা মাসিকপত্রের উল্লেখ আছে।
২.৮ রোজার উপোসের আগে কাবুলিওয়ালারা ভরপেট কী খেয়েছিলেন?
উত্তর: রোজার উপোসের আগে কাবুলিওয়ালারা ভরপেট বড়ো-বড়ো পাঠান 'রোটা’ আর কাবাব খেয়েছিলেন।
২.৯ 'তসবিহ' শব্দের অর্থ কী?
উত্তর: ‘তসবিহ' শব্দের অর্থ মুসলমানদের ‘জপমালা'।
২,১০ আরবি ভাষায় ঈশ্বরের নিরানব্বইটি পবিত্র ও সুন্দর নামকে কী বলা হয় ?
উত্তর: আরবি ভাষায় ঈশ্বরের নিরানব্বইটি পবিত্র ও সুন্দর নামকে 'নব্বদ ও-নও অসমা-ই-হাসানা' বলা হয়।
৩. নিম্নলিখিত শব্দগুলির সন্ধি বিচ্ছেদ করো—হূংকার, স্বনি, বিষয়ান্তর।
উত্তর: হুংকার = হুম্ + কার
স্বস্তি = সু + অস্তি
বিষয়ান্তর = বিষয় + অন্তর
৪. নিম্নলিখিত শব্দগুলির প্রকৃতি-প্রত্যয় নির্ণয় করো—ফিরতি আভিজাত্য, জবরদস্ত, নিবিষ্ট, উৎসাহিত।
উত্তর: ফিরতি–ফির্ + তি
আভিজাত্য—অভিজাত+য
জবরদস্ত-জবর + দস্ত
নিবিষ্ট—নি-বিশ্ + ত
উৎসাহিত—উৎসহ্ + ই + ক্ত
৫. নির্দেশ অনুযায়ী বাক্য পরিবর্তন করো।
৫.১. গাড়িতে সেদিন অসম্ভব ভিড় দেখা গেল ।
উত্তর: গাড়িতে সেদিন ভিড় একটুও কম দেখা গেল না (না-সূচক বাক্যে)
৫.২ কাবুলিওয়ালা পাঠানদের মাতৃভাষা পশতুর সম্মান তখন ছিল না। (প্রশ্নবোধক বাক্যে)
উত্তর: কাবুলিওয়ালা পাঠানদের মাতৃভাষা পশতুর তখন কি আর সম্মান ছিল?
৫.৩ কলকাতার ভাষা তাঁর আয়ত্ত হয়নি।(জটিল বাক্যে)
উত্তর:: কলকাতার যে ভাষা, সে ভাষা তাঁর আয়ত্ত হয়নি।
৫.৪ দুই-একজন মাঝে-মাঝে এক-আধ লবজ ফারসি বললে বটে, কিন্তু এদের বিদ্যেও বেশিদূর এগোল না।(সরল বাক্যে)
উত্তর:: দুই-একজন মাঝে মাঝে এক-আধ লবজ ফারসি বললেও এদের বিদ্যে বেশিদূর এগোল না।
৫.৫ বাংলাদেশে তোমার ডেরা কোথায় ?(নির্দেশক বাক্যে)
উত্তর:: বাংলাদেশে তোমার ডেরা কোথায় বলো।
অথবা, বাংলাদেশে তোমার ডেরা কোথায় জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে।
৬.প্রসঙ্গ উল্লেখ করে টীকা লেখো—কাবুলিওয়ালা, পশতু ফারসি, আফগানিস্তান, বরিশাল, গজল, উর্দু, নমাজ
উত্তর: কাবুলিওয়ালা: আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের অধিবাসীদের মধ্যে যারা বাংলাদেশে নানা জিনিসপত্র বিক্রি ও সুদের
কারবার করতে আসেন, তাদেরকেই সাধারণত কাবুলিওয়ালা বলা হয়।
পাঠ্যাংশে দেহরাদুন এক্সপ্রেসের একটি কামরায় ষোলো জন কাবুলিওয়ালার প্রসঙ্গ উল্লিখিত হয়েছে। লেখক যাত্রাপথে এদের সঙ্গী হন এবং সাংস্কৃতিক আলোচনার মাধ্যমে তাদের কাছে বিপুল গ্রহণযোগ্যতা ও সম্মান অর্জন করেন।
পশতু: পশতু (পশতো ভাষা) আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের কিছু অংশ, বেলুচিস্তান এবং পাঞ্জাবের অংশবিশেষে প্রচলিত ভাষা-বিশেষ। কমবেশি ৪০ লক্ষ লোক এই ভাষায় কথা বলে থাকেন। ইন্দো-ইরানীয় ভাষার ইরানীয় উপশাখা থেকে উদ্ভূত একটি আধুনিক ভাষা হল পশতো বা পশতু। পাঠ্য রচনাংশে পশতু ভাষার
কবি খুশ-হাল খাঁ খট্টকের এবং আদম খাঁ দুরখানির মহব্বতের কিসসার প্রসঙ্গ এসেছে।
ফারসি: সমগ্র ইরানে ব্যবহৃত ইন্দো ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত ইন্দো-ইরানীয় উপগোষ্ঠীর অন্যতম ভাষা এটি। আধুনিক ফারসি ভাষায়
ইরানের উত্তর-পশ্চিমাংশের কথা ভাষার প্রভাব লক্ষ করা যায়। আরবি লিপিকে সামান্য সংশোধিত ও পরিবর্তিত করে ফারসি ভাষা লেখা হয়ে থাকে। পাঠ্যাংশে আফগানিস্তানের শিক্ষিতজনের ভাষা, উচ্চ ও ভদ্রসমাজের ভাষা, সরকারি ভাষা হিসেবে ফারসি ভাষার কথা বলা হয়েছে। এই ভাষায় লেখক কতখানি দক্ষ ছিলেন, তার পরিচয় পাওয়া যায়।
আফগানিস্তান: ভারতের একটি প্রতিবেশী দেশ হল আফগানিস্তান। কাবুল আফগানিস্তানের রাজধানী। এখানে বিভিন্ন জাতি ও ভাষার সমাবেশ লক্ষ করা যায়। পূর্ব আফগানিস্তানের পশতুভাষীরা ওয়াজিরি, আফ্রিদি ইত্যাদি
নামে এবং কাবুল উপত্যকার উপজাতিভুক্ত মানুষরা পাঠান নামে পরিচিত। পশ্চিম আফগানিস্তানের তাজিকরা ফারসিভাষী। পাঠ্যাংশে কাবুলিওয়ালাদের বাসভূমির প্রসঙ্গ আলোচনায় আফগানিস্তানের কথা উঠে এসেছে।
বরিশাল: বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের একটি জেলা, মহকুমা, থানা ও শহর। জেলাটির আয়তন ১,৭৯৮ বর্গকিলোমিটার। এই জেলার প্রধান
নদীগুলির মধ্যে রয়েছে কীর্তনখোলা, মেঘনা, তেঁতুলিয়া, হরিণঘাটা, বালেশ্বর, বিষখালি, আড়িয়ালখাঁ প্রভৃতি। পূর্ববঙ্গের শস্যাগার হিসেবেও এই জেলা প্রসিদ্ধ। মধ্যযুগে এই জেলার নাম ছিল চন্দ্রদ্বীপ ও পরে হয় বাকলা। ১৭৬৫ থেকে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই জেলা বাখরগঞ্জ নামে ব্রিটিশ শাসনের অধীনে থাকে। বালাম চাল, নারকেল, সুপারি, ডালশুক্তি, ঝিনুক প্রভৃতি এই জেলার প্রধান রপ্তানিদ্রব্য। পটুয়াখালিতে বিভিন্ন প্রকার নিব, বড়পাইকী ও উজিরপুরে ছুরি, কাঁচি, জাঁতি, রামদা, শাঁখের করাত তৈরি হয়। পটুয়াখালি ছাড়াও ঝালকাঠি, ভোলা, দৌলত খাঁ প্রভৃতি এখানকার ব্যাবসাবাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র। পাঠ্যাংশে আগা সাহেবের ব্যাবসাকেন্দ্র হিসেবে বরিশালের পটুয়াখালি বন্দরের প্রসঙ্গ এসেছে।
কাবুলিওয়ালা আগা-সাহেব যে বরিশালি ভাষাতেও দক্ষতা অর্জন করেছেন, বর্ণনাসূত্রে লেখক সে-কথাও জানাতে ভোলেননি।
গজল: ফারসি ভাষার প্রণয়সংগীত হল গজল। গজল কয়েকটি ‘শের’ বা couplet নিয়ে গঠিত। গজলের প্রতিটি পক্তি একই ছন্দে লিখিত হয়।
গজলের শেষ শেরে সাধারণভাবে গীতিকারের ছদ্মনাম থাকে। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে গয়া থেকে কলকাতায় আসার পথে ট্রেনে লেখক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ঘটনাচক্রে ষোলো জন কাবুলিওয়ালার সহযাত্রী হয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় লেখক তাদের মধ্যে কেউ পশতু ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি খুশ-হাল খাঁ বউকের গজল জানেন কি না জানতে চান। তখন একজন পাঠান ব্যক্তি উৎসাহিত হয়ে তাঁকে পশতু ভাষায় রচিত খুশ হাল খাঁ খটকের গজল গেয়ে শোনায়।
উর্দু: তুর্কি শব্দ ‘ওর্দু' থেকে এসেছে উর্দু। এর অর্থ শিবির বা ক্যাম্প। এটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের ইন্দো-আর্য শাখার ভাষা।
পাকিস্তান, ভারত, আফগানিস্তান ছাড়াও বিশ্বের নানান দেশে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষেরা উর্দুতে কথা বলেন। দেহরাদুন এক্সপ্রেসে
কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে গয়া থেকে কলকাতা ফেরার সময় লেখক তাঁর দুই সহযাত্রীকে পশতু ভাষায় নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় নিমগ্ন থাকতে দেখেছিলেন। তাঁর পশতু ভাষা জানা না থাকলেও উর্দু জানার সুবাদে তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন।
সমাজ: 'নমাজ' শব্দটি ফারসি। আরবিতে বলা হয় 'সালাত'। ইসলাম ধর্ম যে পাঁচটি মূলভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, তার মধ্যে নমাজ হল দ্বিতীয়। নমাজকে ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ স্তম্ভ বলে ধরা হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মে সারাদিনে পাঁচবার নমাজ পড়া অবশ্যকর্তব্য রূপে চিহ্নিত হয়েছে। এ ছাড়াও নানা উপলক্ষ্যে নমাজ পড়া হয়ে থাকে। ইসলাম ধর্মে মনে করা হয়, নমাজ সমস্ত রকমের অপকর্ম ও পাপ থেকে মানুষকে রক্ষা করে।
৭. নীচের খাগুলির উত্তর কয়েকটি বাক্যে शেখো।
৭.১ স্টেশনে পৌঁছে লেখক কী দেখেছিলেন ?
উত্তর: ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত 'পথচলতি' রচনাংশে গয়া থেকে লেখকের কলকাতায় ফেরার এক চমকপ্রদ বর্ণনা রয়েছে। লেখকের কথা অনুযায়ী, সম্ভবত ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের শীতকালে ঘটনাটি ঘটেছিল। একটি মধ্যম শ্রেণির রিটার্ন টিকিটের ফিরতি অংশ সঙ্গে নিয়ে লেখক দেহরাদুন এক্সপ্রেস ধরার জন্য স্টেশনে এসেছিলেন। ট্রেন সেদিন।
সময়মতো এলেও কোনো-এক অজানা কারণে গাড়িতে সেদিন অসম্ভব ভিড় ছিল। মধ্যম শ্রেণির কামরায় ওঠা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয় শ্রেণির কামরাগুলিতে মানুষজন মেঝেতে বিছানা করে, কোথাও-বা বসে অথবা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সমস্ত ট্রেনের অবস্থা দেখার জন্য লেখক ইঞ্জিনের
দিকে এগোলেন। দেখলেন, তৃতীয় শ্রেণির একটি বড়ো ‘বগির’ কাছে একেবারেই লোকের ভিড় নেই। লেখক সামনে গিয়ে দেখলেন যে সেটি জনাকয়েক কাবুলিওয়ালা দখল করে রেখেছে।
৭.২ দু-চারটি ফারসি কথা বলতে পারার ক্ষমতা লেখককে কী রকম সাহস দিয়েছিল ?
উত্তর: ‘পথচলতি’ শীর্ষক রচনাংশে লেখক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যে সময়ের কথা বলেছেন, সেসময়ও ফারসি ছিল আফগানিস্তানের শিক্ষিত জনের ভাষা। উচ্চ ও ভদ্রসমাজের ভাষা, সরকারি ভাষা হওয়ার কারণে
তার সম্মান ছিল অনেক। পাঠানদের মাতৃভাষা পশতুর তখন তেমন সম্মান ছিল না। সেই সম্মান না থাকার কারণ হল পশতুভাষী লোকেদের মধ্যে
শিক্ষা ও সংস্কৃতির অভাব। তা ছাড়া, পশতু ভাষায় সাহিত্যও তেমনভাবে রচিত হয়নি। গদ্যের শুরুতেই দেখি, গয়া থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য স্টেশনে পৌঁছে লেখক দেখেছিলেন, কাবুলিওয়ালাদের দখল করা একটি কামরাতেই একমাত্র কিছুটা জায়গা খালি রয়েছে। লেখক মনে করলেন, কাবুলিওয়ালাদের মধ্যে ফারসি বলাটা যখন শিক্ষা ও আভিজাত্যের লক্ষণ, তখন তিনি যদি তাদের সঙ্গে ফারসিতে দু-একটাও কথা বলেন, তাহলে তারা বাঙালির মুখে ফারসি শুনে হকচকিয়ে যাবে আর তারপরে হয়তো তাঁর জন্য জায়গাও ছেড়ে দিতে পারে।
৭.৩ ‘আলেম' শব্দের মানে কী? লেখককে কারা, কেন 'এক মস্ত আলেম' ভেবেছিলেন ?
উত্তর: ‘আলেম' শব্দের অর্থ: 'আলেম' বা 'আলিম' শব্দের অর্থ হল 'সর্বজ্ঞ পণ্ডিত ব্যক্তি'। অর্থাৎ যিনি সব কিছু জানেন।
> উদ্দিষ্ট ব্যক্তিদের লেখককে যন্ত্র 'আলেম' ভাবার কারণ: দেহরা- দুন এক্সপ্রেসের তৃতীয় শ্রেণির কামরার কাবুলিওয়ালারা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়কে 'এক মস্ত আলেম' ভেবেছিলেন। বাঙালি হয়েও তিনি যেভাবে ফারসি ভাষায় অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে কথাবার্তা বলতে
শুরু করেন, তাতে তারা হতভম্ব হয়ে পড়ে। তাদের ফারসি জ্ঞানের অভাবের সুযোগ নিয়ে লেখক কথা বলতে গিয়ে সামান্য তাচ্ছিল্যের
ভাব দেখিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে একটি অল্পবয়সি ছেলে ফারসি জানে বলে দাবি করে এবং সে লেখকের অভিপ্রায় জানতে চায়।
লেখক জানান তিনি কলকাতা শহরে যাবেন আর সে কারণেই তিনি ওই কামরায় জায়গা পেতে চাইছেন। এ কথা শুনে খানিক দ্বিধার পর
সেই ছেলেটি দলের অনুমতি পেয়ে লেখককে ভিতরে আসতে বলে।
লেখকের এই ফারসি জ্ঞানের কারণেই কাবুলিওয়ালারা তাঁকে ‘এক মস্ত আলেম' ভেবেছিলেন।
৭.৪ আগা সাহেব সম্বন্ধে যা জানা গেল, সংক্ষেপে লেখো।
উত্তর: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত 'পথচতি' রচনাংশে আগা- সাহেবের প্রসঙ্গ এসেছে। লেখক গয়ায় অবস্থিত তাঁর শ্বশুরবাড়ি থেকে কলকাতায় ফেরার সময় দেহরাদুন এক্সপ্রেসের তৃতীয় শ্রেণির একটি কামরায় কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গ লাভ করেন। বৃদ্ধ আগা-সাহেবের সঙ্গে সেখানেই তাঁর আলাপ ঘটে। লেখক জানতে পারেন, আগা সাহেবের ব্যাবসার অঞ্চল হল পূর্ববঙ্গের পটুয়াখালি বন্দর অঞ্চল। তিনি বাংলার পল্লি অঞ্চলে শীতবস্ত্র আর হিং বিক্রি করেন, তা ছাড়া কৃষকদের টাকা ধার দেওয়ার ব্যাবসাও করে থাকেন। এমনকি, দীর্ঘদিন বাংলাদেশে থাকার
কারণে বরিশালের ভাষা তিনি আপন মাতৃভাষার মতোই বলতে পারেন। বরং কলকাতার ভাষাই তাঁর অজানা থেকে গেছে।
৭.৫ লেখকের সামনের বেঞ্চির দুই পাঠান সহযাত্রী নিজেদের মধ্যে যে আলোচনা করছিলেন তা নিজের ভাষায় লেখো। লেখক কীভাবে
সেই কথার অর্থ বুঝতে পারলেন ?
উত্তর: দুই পাঠান সহযাত্রীর আলোচনা: ‘পথচতি' গদ্যাংশে লেখক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর গয়া থেকে কলকাতায় ফেরার
রেলযাত্রার বিবরণ দিয়েছেন। ট্রেনে তৃতীয় শ্রেণির একটি কামরায় ষোলো জন পাঠানের সঙ্গে কলকাতা ফিরছিলেন লেখক। তখন তিনি সকৌতুকে লক্ষ করেন তাঁর সামনের বেঞ্চের দুজন পাঠান সহযাত্রী নিজেদের মধ্যে তাদেরই ভাষায় তাঁকে নিয়ে আলোচনা করছে। লেখক সম্বন্ধে তাদের উপলব্ধিটি হল এই যে, তিনি খুব বিদ্বান আর অত্যন্ত বুদ্ধিমান। ইংরেজদের লেখা সব বই তিনি যেমন পড়েন, তেমনই আবার ফারসিও পড়েন। এভাবে
কাবুলিওয়ালাদের সম্বন্ধেও তিনি কতই না খবর জেনেছেন! এমনকি তাদের আটপৌরে কথাবার্তাও তিনি অনেকখানি আয়ত্ত করে নিয়েছেন। ট্রেনে ওঠার শুরুতেই ফারসি ভাষায় কথাবার্তা বলা আর পরে পাঠানদের
পশতু ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি খুশ হাল খাঁ খটকের গজল কিংবা আদম খাঁ আর দুরখানির মহব্বতের কিসসা সম্পর্কে লেখকের আগ্রহ দেখেই তারা এমন আলোচনা শুরু করে।
লেখকের অর্থ উপলব্ধি: লেখক পশতু ভাষা না বুঝলেও এই দুই পাঠান সহযাত্রীর আলোচনায় প্রচুর ফারসি আর আরবি শব্দের ব্যবহার
খেয়াল করেছিলেন। উর্দু ভাষা জানতেন বলে তাদের কথা লেখকের বুঝতে সুবিধে হয়েছে।
৮. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের ভাষায় লেখো।
৮.১ পাঠ্য গদ্যটির ভাবের সঙ্গে 'পথচলতি' নামটি কতখানি সংগতিপূর্ণ হয়েছে, বিচার করো।
উত্তর: 'উপরে নামকরণ' অংশটি দ্যাখো।
৮.২ পাঠ্য গদ্যাংশটি থেকে কথকের চরিত্রের কোন বৈশিষ্ট্যগুলি
তোমার চোখে ধরা পড়েছে, বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে লেখো।
উত্তর। কথামুখ: ভাষাতাত্ত্বিক, সুলেখক, অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত 'পথচলতি' শীর্ষক গদ্যাংশে লেখক তথা গল্পকথকের
চরিত্রের নানান উল্লেখযোগ্য দিক প্রকাশিত হয়েছে। অবিচলিত: লেখক সেদিন গয়া থেকে কলকাতার ট্রেন ধরার জন্য প্ল্যাটফর্মে এসে প্রচণ্ড ভিড় দেখেও বিচলিত হয়ে পড়েননি। সাহসী:।জবরদস্ত চেহারার কয়েকজন কাবুলিওয়ালার হুংকারে যখন সাধারণ যাত্রী থেকে শুরু করে রেলের কর্মচারী বা পুলিশ পর্যন্ত তাদের দখল করা কামরাটির ত্রিসীমানায় যাচ্ছিলেন না, তখন সাহসী লেখক সেই কামরাতেই ওঠার সিদ্ধান্ত নেন এবং শেষপর্যন্ত সফলও হন। বহুভাষাবিদ: বর্ণিত কাহিনি থেকে লেখকের বাংলা, ইংরেজি তো বটেই, এমনকি ফারসি, আরবি, হিন্দুস্থানি, উর্দু ভাষা ও সাহিত্যজ্ঞানেরও পরিচয় পাওয়া যায়।
অচেনা-অজানা পরিবেশে যানিয়ে নেওয়া: অজানা-অচেনা পরিবেশে। ভিন্ন রুচি ও ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে সময় কাটানো এবং সম্পূর্ণ প্রতিকূল ও বিরুদ্ধ পরিবেশকেও নিজের অনুকূলে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে গল্পকথকের আন্তরিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। বন্ধুত্বপরায়ণ ও সহানুভূতিশীল: অত্যন্ত পণ্ডিত মানুষ হয়েও লেখক অতি সাধারণ কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে যেমনভাবে মিশে গেছেন, তাতে তাঁর চরিত্রের
বন্ধুত্বপরায়ণতা ও সহানুভূতির দিকটি ফুটে উঠেছে।
লেখকের সহজ, সরল, আন্তরিক, আলাপী ও বৈঠকি মেজাজটি রচনাটিকে সুখপাঠ্য করে তুলেছে।
৮.৩ কথকের সঙ্গে কাবুলিওয়ালাদের প্রারম্ভিক কথোপকথনটি।সংক্ষেপে বিবৃত করো।
উত্তর: ‘পথচলতি’ গদ্যাংশে লেখক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ট্রেনে চড়ে গয়া থেকে কলকাতায় ফেরার কাহিনি বর্ণনা করেছেন ৷
প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে লেখক দেহরাদুন এক্সপ্রেসের কোনো কামরাতেই ওঠার মতো পরিস্থিতি দেখতে পেলেন না। তবে প্রচণ্ড ভিড় সেই ট্রেনের একটি
তৃতীয় শ্রেণির কামরা প্রায় খালি ছিল। সেখানে লেখক ঢুকতে গেলেই পাঁচ- ছয়জন কাবুলিওয়ালা একসাথে অত্যন্ত গম্ভীরভাবে বলে ওঠে যে, সেই কামরা কেবল পাঠানদের জন্য। জবাবে লেখক ফারসি ভাষাতে তাদের জানান যে, কেবল একজন মানুষের জন্য তিনি গাড়িতে জায়গা চাইছেন। সেই কাবুলিওয়ালাদের মধ্যে ভালো ফারসি-জানা লোক না থাকায় লেখক পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ নেন। তিনি গলা চড়িয়ে উপহাসের সঙ্গে তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে বলেন যে আফগানিস্তানের কোন অঞ্চল থেকে তারা এসেছেন যে ফারসিতে কথা বলবার ক্ষমতা তাদের নেই? এই পরিস্থিতিতে একজন অল্পস্বল্প ফারসি জানা যুবক প্রশ্ন করে যে তিনি কী
চান? লেখক তখন বলেন যে তাঁর সেই কামরায় জায়গা দরকার। তিনি কোথায় যাবেন এই প্রশ্ন এলে লেখক এ কথাও বললেন যে তিনি কলকাতা
শহরে যাবেন। এরপর পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে কাবুলিওয়ালারা লেখককে তাদের কামরায় প্রবেশ করার অনুমতি দেয়। এভাবেই কথকের সঙ্গে কাবুলিওয়ালাদের প্রারম্ভিক কথোপকথনটি হয়েছিল।
৮.৪ কথক কেন বলেছেন- "যেন এক পশতু সাহিত্য-গোষ্ঠী বা সম্মেলন লাগিয়ে দিলুম।”—সেই সাহিত্য সম্মেলনের বর্ণনা দাও।
উত্তর: শুরুর কথা: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত 'পথচলতি ' রচনাংশে স্বয়ং লেখক এই মন্তব্যটি করেছেন। পয়ায় অবস্থিত শ্বশুরবাড়ি থেকে কলকাতায় ফেরার সময় ট্রেনে লেখক কাবুলিওয়ালাদের একটি যোলো জনের দলকে সহযাত্রী হিসেবে পান। খুশ-হাল খাঁ খউকের গজল: কথা প্রসঙ্গে পন্ডিত লেখক ওই কাবুলিওয়ালাদের কাছে তাদের মাতৃভাষা পশতুর সর্বশ্রেষ্ঠ কবি সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমসাময়িক খুশ হাল বা ঘটকের গজল শোনার আগ্রহ
প্রকাশ করেন। সবচেয়ে ওপরের বাংকে বসে থাকা এক কাবুলিওয়ালা অত্যন্ত খুশি আর উৎসাহিত হয়ে নানা কায়দায় তাঁকে সেই গান শোনায়। তাদের সংস্কৃতিতে লেখকের আগ্রহ দেখে তারা খুবই আনন্দিত হয়। 'দিল- 'ভাঙা' মহব্বতের কাহিনি। এরপর লেখক তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে আদম খাঁ আর দূরখানির কিসসা কেউ জানে কি না জানতে চাইলেন। তখন অপর এক পাঠান তাঁকে সেই 'দিল-ভাঙা' মহব্বতের কাহিনি কর্কশ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে গেয়ে ও পাঠ করে শোনায়। অনুরাগ ও আন্তরিকতার পরিচয়: এর মধ্য দিয়ে কাবুলিওয়ালাদের সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ ও আন্তরিকতার পরিচয় পেয়েছেন লেখক ৷
শেষের কথা: সাহিত্য ও সংগীতের সেই ক্ষণিক, অপটু অথচ আনন্দময় চর্চাকেই লেখক পাঠ্যাংশে 'পশতু-সাহিত্য-গোষ্ঠী বা সম্মেলন’
আখ্যা দিয়েছেন।
৮.৫ ‘পথচলতি” রচনায় ভাষা ও সংস্কৃতির বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও যে সহজ বন্ধুত্ব ও উদার সমানুভূতির ছবিটি পাওয়া যায় তার স্বরূপ
বিশ্লেষণ করো। বর্তমান সময়ে এই বন্ধুত্ব ও সমানুভূতির প্রাসঙ্গিকতা বুঝিয়ে দাও।
উত্তর: সহজ বন্ধুত্ব ও উদার সমানুভূতির ছবি: প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘পথচলতি’ রচনাংশে ভাষা ও সংস্কৃতির
বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এক সহজ বন্ধুত্ব ও উদার সমানুভূতির চিত্র ফুটে উঠেছে। সেটি সম্ভবত ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের শীতকালের ঘটনা। গয়ায়
অবস্থিত শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার পথে দেহরাদুন এক্সপ্রেসের একটি কামরায় প্রায় ষোলো জন পাঠান মর্দের সঙ্গে লেখক কীভাবে ফারসি,
হিন্দুস্থানি আর বাংলা বলে বন্ধুত্ব গড়ে তুললেন এবং তাদের সঙ্গে সাংস্কৃতিক নানা তথ্য বিনিময় করলেন, সে-কথা এই রচনাংশটিতে স্থান
পেয়েছে। গোটা যাত্রাপথে লেখক তাদের থেকে খুশ হাল খাঁ খটকের গজল এবং আদম খাঁ আর দুরখানির কিসসা যেমন শুনলেন, তেমনই তাঁর
পাঠান সহযাত্রীরাও তাঁকে অত্যন্ত বিদ্বান আর বুদ্ধিমান বিবেচনা করে যথেষ্ট সম্মান করল।
বর্তমান সময়ে প্রাসঙ্গিকতা: বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতেও ভাষা কিংবা সংস্কৃতিগত দিক থেকে যাঁরা অনেকটাই আলাদা —তাঁদের সঙ্গে
সদ্ভাব বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। এভাবেই সমাজে শান্তি ও প্রীতি ভাব বজায় রাখা সম্ভব। শুধু দেশে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও নানান
বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির অশুভ প্রচেষ্টা মানুষের এই শুভবুদ্ধিতে পিছু হটতে বাধ্য। সকলেই বিশ্বনাগরিক—এই বোধ জন্ম নিলে সকলেরই মঙ্গল সাধিত হবে।
৯. রেলভ্রমণের সময় অচেনা মানুষের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্বের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি রম্যরচনা লেখো। তোমার লেখাটির সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ছবি আঁকো।
উত্তর-নিজে করো।
