পরবাসী || অষ্টম শ্রেণী || হাতে কলমে প্রশ্নের উত্তর || para basi || class 8 || question answer
![]() |
অষ্টম শ্রেণীর বাংলা
অধ্যায় ৭
পরবাসী
বিষ্ণু দে
উৎস। 'পরবাসী' কবিতাটি কবি বিষ্ণু দের 'তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ' কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
কবি পরিচিতি: ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার পটলডাঙায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম অবিনাশ চন্দ্র দে। মিত্র ইন্সটিটিউশন এবং সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুলে তিনি পড়েছেন। বঙ্গবাসী কলেজ থেকে আইএ পাস করেন। এরপর ইংরেজি সাহিত্যে তিনি বিএ এবং এমএ পাস করেন। পড়াশোনা শেষ করে বিষ্ণু দে রিপন কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। বিভিন্ন সময়ে তিনি 'কল্লোল', 'পরিচয়' ইত্যাদি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'উর্বশী ও আর্টেমিস' ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। তাঁর রচিত অন্যান্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—'চোরাবালি', 'পূর্বলেখ', 'সন্দীপের চর', ‘অন্বিষ্ট’, ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ' প্রভৃতি। তাঁর লেখা প্রবন্ধগ্রন্থ হল 'বুচি ও প্রগতি', 'সাহিত্যের ভবিষ্যৎ', 'সাহিত্যের দেশ বিদেশ" প্রভৃতি। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকাটির নাম 'নিযুক্ত'। তিনি ফরাসি লেখক ভেরকরের 'La Silence de La Mer এর অনুবাদ করেছেন ‘সমুদ্রের মৌন' নামে। এ ছাড়াও 'এলিয়টের কবিতা', 'হে বিদেশী ফুল', 'আঠারোটি কবিতা”, আফ্রিকায় এশিয়ায় মুরলী মৃদঙ্গ তুর্যে তাঁর অনুবাদ-দক্ষতার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তাঁর রচিত 'স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ' নামের গ্রন্থের জন্য ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার 'জ্ঞানপীঠ' লাভ করেছেন। তাঁর রচিত আত্মজীবনীটির নাম ছড়ানো এই জীবন'। সাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, নেহর স্মৃতি পুরস্কার, সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার লাভ করেছেন। তাঁর সম্পাদিত একটি গ্রন্থের নাম 'একালের কবিতা”। এই বিখ্যাত কবি ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগমন করেন।
সারসংক্ষেপ : কবি বিষ্ণু দে রচিত ‘পরবাসী' কবিতায় লুপ্তপ্রায় ও বিপন্ন প্রকৃতির জন্য কবির বেদনা এবং অশেষ যন্ত্রণার ছবি ফুটে উঠেছে। কবি আমাদের দেশের প্রকৃতির মনোরম রূপ এই কবিতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। অবাক দৃষ্টিতে কবি দেখেছেন নিটোল টিলার পলাশের ঝোপে বনময়ূরের হঠাৎ আনন্দে নেচে ওঠা। সেই নৃত্যের সৌন্দর্য কবিকে মনে করায় কত্থক নাচের কথা। নির্জন সেই বনভূমিতে তাঁবুর ছায়ায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন কবি। তখন তিনি সূর্যের আলোয় উজ্জ্বল জলরাশিকে ময়ূরের নাচের ছন্দে ছন্দে আন্দোলিত হতে দেখেছেন। শান্ত ও নিরীহ প্রাণী হরিণকে গোপনে তিনি যেমন জল খেতে দেখেছেন, তেমনই তাঁর চোখে পড়েছে লোভী ও হিংস্র চিতার নিঃশব্দ আনাগোনা। চিতার সেই নিঃশব্দ চলার মধ্যে বন্যপ্রাণের যে গতিময়তা ফুটে উঠেছে, তার মধ্যে কবি খুঁজে পেয়েছেন কথাকলি নাচের ছন্দকে। কিন্তু এরপরেই কবি প্রকৃতির কুৎসিত রূপটি তুলে ধরেছেন। সুন্দরী
প্রকৃতিকে নিজের সীমাহীন লোভ আর সভ্যতা-বিস্তারের প্রবল বাসনায় ধ্বংস করেছে মানুষ। কুঠারের আঘাতে বনভূমি ধ্বংস করেছে অথচ গড়ে তুলতে পারেনি আদর্শ বসতি। ধু-ধু প্রান্তরে সব হারানোর হাহাকার নিয়ে বয়ে চলে বাতাস। কবির আক্ষেপ, অরণ্য ও প্রকৃতিকে ধ্বংস করে মানুষ গ্রামসভ্যতারও ধ্বংস ডেকে এনেছে। গ্রাম ধ্বংস হলেও গড়ে ওঠেনি সেই শহর যা প্রকৃতির সৌন্দর্যকে দু-হাত ভরে গ্রহণ করতে পারে। নগরসভ্যতার আস্ফালনই চোখে পড়ে শুধু। ময়ূর-সহ প্রকৃতির সমস্ত সুন্দর বস্তুই আজ মানুষের লোভের শিকার হয়ে পণ্যে পরিণত হয়েছে। কবি চেয়েছেন, অবিবেচক মানুষের এই সব হঠকারী কাজকর্মের প্রতিবাদ হোক। অসহায় নীরবতা ছেড়ে মানুষ সচেতন হয়ে উঠুক। নদী-গাছ-পাহাড় তাদের হারিয়ে যাওয়া মর্যাদা আর গুরুত্ব ফিরে পাক। প্রকৃতির কোলে মানুষ তার যথাযোগ্য স্থানটিকে খুঁজে নিক। অনুর্বর, ধূসর মরুভূমির মতো নিষ্প্রাণ, দূষিত পৃথিবী আবার সুন্দর এবং মানুষের বাসযোগ্য হয়ে উঠুক।
নামকরণ। কবিতার নামকরণ নানাভাবেই হতে পারে। তবে বিষয়বস্তুর ব্যঞ্জনা দেয় যে নাম, তা-ই সবচেয়ে জনপ্রিয়। কবি বিষ্ণু দে রচিত 'পরবাসী' কবিতায় কবি নিজেকে ‘পরবাসী' মনে করেছেন। ‘পরবাসী' শব্দটি এসেছে ‘প্রবাসী’ থেকে, যার অর্থ হল——যে অন্যের ভূমিতে বাস করে।' কবির কাছে তাঁর বহুদিনের চেনা, পরিচিত মাতৃভূমি আজ হয়ে উঠেছে অপরিচিত।
মানুষের অবিচারে, নিষ্ঠুরতায়, লোভে প্রকৃতি ধ্বংস হয়েছে, কেড়ে নিয়েছে সে বন্যপ্রাণীর আজন্ম বাসভূমি। মানুষ আর প্রকৃতির কোলে তার শান্তির আশ্রয় খুঁজে পায় না। চিরকালীন আশ্রয় লুপ্ত হয়ে যাওয়ার যন্ত্রনাই কবিকে নিজভূমে ‘পরবাসী’ করে তুলেছে। কবির এই আক্ষেপই ফুটে উঠেছে কবিতাটিতে। কবে এমন দিন আসবে, যেদিন স্বভূমিতে ‘পরবাসী” হওয়ার বেদনা থেকে তিনি মুক্তি পাবেন। আবার তিনি ফিরে পাবেন মাতৃরূপী প্রকৃতির কোলে শান্তির আশ্রয়। এই অর্থে আলোচ্য কবিতায় ‘পরবাসী’ নামকরণটিকে সার্থক বলেই মনে হয়।
'হাতেকলমে' অনুশীলন প্রশ্নের উত্তর
১. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর দাও।
১.১ কবি বিষ্ণু দে-র প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম কী ?
উত্তর: কবি বিষ্ণু দে-র প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম 'উর্বশী ও আর্টেমিস'।
১.২ তাঁর লেখা দুটি প্রবন্ধের বইয়ের নাম লেখো।
উত্তর: কবি বিন্নু দে রচিত দুটি প্রবন্ধের বই হল 'রুচি ও প্রগতি' এবং ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ'।
২. নিম্নরেখ শব্দগুলির বদলে অন্য শব্দ বসিয়ে অর্থপূর্ণ বাক্য তৈরি করো। প্রথমটি করে দেওয়া হল।
২.১ দুই দিকে বন, মাঝে ঝিকিমিকি পথ।
উত্তর: দুই দিকে বন, মাঝে আলোছায়া পথ।
২.২ এঁকে বেঁকে চলে প্রকৃতির তালে তালে ।
উত্তর: এঁকে বেঁকে চলে প্রকৃতির ছন্দে ।
২.৩ তাঁবুর ছায়ায় নদীর সোনালি সেতারে।
উত্তর: তাঁবুর ছায়ায় নদীর কুলুকুলু ধ্বনিতে
২.৪ হঠাৎ পুলকে বনময়ূরের কথক।
উত্তর: হঠাৎ পুলকে বনময়ূরের নাচ ।
২.৫ বন্য প্রাণের কথাকলি বেগ জাগিয়ে।
উত্তর: বন্য প্রাগের নৃত্যের বেগ জাগিয়ে।
৩.১ পথ কীসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে।
উত্তর: কবি বিষ্ণু দে রচিত 'পরবাসী' কবিতায় উল্লিখিত পথ বনের মধ্যে এঁকেবেঁকে প্রকৃতির তালে তাল মিলিয়ে চলে।
৩.২ চিতার চলে যাওয়ার ছন্দটি কেমন।
উত্তর: 'পরবাসী' কবিতায় বর্ণিত চিতার চলে যাওয়ার ছন্দে রয়েছে লোভ ও হিংসার মনোভাব।
৩.৩ ময়ূর কীভাবে মারা গেছে?
উত্তর: 'পরবাসী' কবিতায় ময়ূরের মৃত্যুর কারণ হিসেবে কবি মানুষের সীমাহীন লোভকে এবং সুন্দর জিনিসমাত্রেই তাকে পণ্যে পরিণত করার মনোভাবকে চিহ্নিত করেছেন।
৩.৪ প্রান্তরে কার হাহাকার শোনা যাচ্ছে ?
উত্তর: ‘পরবাসী' কবিতায় প্রকৃতি ধ্বংস করে তৈরি হওয়া ধূসর, রুক্ষ প্রান্তরে শুকনো হাওয়ার হাহাকার শোনা যাচ্ছে ।
৩.৫ পলাশের ঝোপে কবি কী দেখেছেন ?
উত্তর: ‘পরবাসী' কবিতায় কবি নিটোল টিলার লাল পলাশের ঝোপে। ময়ূরকে হঠাৎ প্রাণের আনন্দে নেচে উঠতে দেখেছেন, যা দেখে তাঁর কত্থক নাচের কথা মনে পড়েছে।
৪. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর কয়েকটি বাক্যে লেখো।
৪.১ জঙ্গলের কোন্ কোন্ প্রাণীর কথা কবি এই কবিতায় বলেছেন ?
উত্তর: কবি বিষ্ণু দে ‘পরবাসী' কবিতায় যন্ত্রসভ্যতার গ্রাসে ধ্বংস হওয়ার আগেকার প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণের ছবি এঁকেছেন। এতে ফুটে উঠেছে কয়েকটি বন্যপ্রাণীর চিত্র। কবিতায় ছোট্ট খরগোশ, বনময়ূর, হরিণ ও চিতার কথা বলেছেন কবি। এই প্রাণীগুলি প্রকৃতির বুকে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত।
৪.২ সেতারের বিশেষণ হিসেবে কবি 'সোনালি' শব্দের ব্যবহার করেছেন কেন ?
উত্তর: ‘পরবাসী' কবিতায় কবি বিষ্ণু দে নদীর কুলকুল শব্দকে সেতারের সুরেলা আওয়াজের সঙ্গে তুলনা করেছেন। সূর্যের আলোয় নদীর জল
আলোকিত হয়ে উঠেছে। সোনালি আলোয় সেজে ওঠা সেই নদীর নাচের ছন্দ কবির কাছে সেতারের সংগীতের তাল ও ছন্দের সঙ্গে একাকার হয়ে
গেছে। তাই সেতারের বিশেষণ হিসেবে 'সোনালি' শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
৪.৩ কখক ও কথাকলির কথা কবিতার মধ্যে কোন্ প্রসঙ্গে এসেছে?
উত্তর: কথক হল উত্তর ভারতের অন্যতম ধ্রুপদি নৃত্যকলা। লখনউ ও জয়পুরে এই নৃত্যের উদ্ভব বলে মনে করা হয়ে থাকে। কথাকলি হল
দক্ষিণ ভারতের কেরলের নৃত্যশৈলী। কথাকলি নাচের বিষয়বস্তু হল, রামায়ণ-মহাভারত ও পুরাণের কাহিনি। কবিতায় বনময়ূরের নাচের প্রসঙ্গে কথক এবং চিতার চলাফেরার প্রসঙ্গে কথাকলির কথা উল্লিখিত হয়েছে।
৪.৪ 'সিন্ধুমুনির হরিণ-আহবান' কবি কীভাবে শুনেছেন ?
উত্তর: 'সিন্ধুমুনির হরিণ-আহ্বান' উল্লেখের মধ্য দিয়ে কবি রামায়ণে উল্লিখিত সিন্ধুমুনির কাহিনিটি তুলে ধরেছেন। অন্ধমুনির পুত্র সিন্ধু রাত্রিবেলায় কলশি নিয়ে নদীতে জল ভরতে গেছিলেন। রাজা দশরথ তখন ভুল করে হরিণ জল খেতে এসেছে ভেবে শব্দভেদী বাণ নিক্ষেপ করেন।
এর ফলে সিন্ধুমুনির মৃত্যু হয় এবং দশরথও অন্ধমুনির অভিশাপে পরবর্তীকালে পুত্রশোকে প্রাণ হারান। সিন্ধুমুনি নিজের অজ্ঞাতসারেই আপন মৃত্যুকে আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কবির মনে হয়েছে, হরিণ একইভাবে তার জল খাওয়ার শব্দে আহ্বান জানিয়েছে চিতাবাঘকে। ফলে অনিবার্যভাবেই নিজের মৃত্যুকেও ডেকে আনেছে সে।
৪.৫ "ময়ূর মরেছে পণ্যে”- এই কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কী ?
উত্তর: ‘ময়ূর মরেছে পণ্যে'—কথাটির অন্তর্নিহিত অর্থ হল মানুষের ক্রমবর্ধমান, সীমাহীন লোভের শিকার হয়েছে ময়ূর। ময়ুরের সৌন্দর্যই তার
ধ্বংসের কারণ। সুদৃশ্য পালকের কিংবা সুস্বাদু মাংসের লোভে মানুষ তাকে নির্বিচারে হত্যা করে পণ্যের সামগ্রী করে তুলেছে। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আসলে পণ্য সভ্যতার আগ্রাসনে প্রকৃতির ধ্বংসের কথাই উঠে এসেছে।
৫. নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর নিজের ভাষায় লেখো।
৫.১ কবি নিজেকে পরবাসী বলেছেন কেন ?
উত্তর: ‘পরবাসী’ কবিতায় কবি নিজেকে নিজের মাতৃভূমিতেই ‘পরবাসী' মনে করেছেন। যে ব্যক্তি অন্যের দেশে বাস করে, তাকেই প্রবাসী বা পরবাসী বলা হয়। অতীতে দেখা কবির চেনা প্রকৃতিকে কবি প্রতিনিয়ত ধ্বংসের মুখোমুখি হতে দেখেছেন। তিনি দেখেছেন মানুষ কীভাবে নষ্ট করেছে গ্রাম, বনভূমি;নির্বিচারে হত্যা করেছে বন্যপ্রাণী আর পাখির দলকে। কবি নাগরিক সভ্যতার হাতে প্রকৃতির হত্যাকাণ্ড দেখেছেন, কিন্তু নগরের উত্থান দেখেননি। বন কেটে তৈরি হওয়া রুক্ষ প্রান্তরে আজ শুধুই শুকনো হাওয়ার হাহাকার। সেদিনের প্রাণচঞ্চল গ্রাম আজ হয়ে পড়েছে নিষ্প্রাণ। চেনা স্বদেশ আজ তাঁর নিজের কাছেই সম্পূর্ণ অপরিচিত হয়ে উঠেছে।
তাই কবি নিজেকে পরবাসী বলেছেন।
৫.২ “জঙ্গল সাফ, গ্রাম মরে গেছে, শহরের পত্তন নেই…”–প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এই পঙক্তিটির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করো ।
উত্তর: কবি বিষ্ণু দে রচিত ‘পরবাসী' কবিতা থেকে গৃহীত আলোচ্য পঙ্ক্তিটিতে বোঝানো হয়েছে যে মানুষই তার ক্রমবর্ধমান লোভের কারণে বনভূমি ধ্বংস করেছে। লোভের বশে মানুষ গ্রাম বিনষ্ট করেছে, অথচ আদর্শ নগরের পত্তন ঘটাতে পারেনি। নগর বানাতে গিয়ে ক্রমশ প্রকৃতি থেকে দূরে সরে গেছে মানুষ। প্রকৃতির সৌন্দর্য আর ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে, বন্যপ্রাণীরাও মানুষের লোভের শিকার হয়েছে। গ্রামও হারিয়ে ফেলেছে তার চরিত্র। কিন্তু প্রকৃত নগরসভ্যতার বিকাশ ঘটেনি।
৫.৩ ‘পরবাসী' কবিতার প্রথম তিনটি স্তবক ও শেষ দুটি স্তবকের মধ্যে বক্তব্য বিষয়ের কোনো পার্থক্য থাকলে তা নিজের ভাষায় লেখো।
উত্তর: কবি বিষ্ণু দে রচিত 'পরবাসী' কবিতাটি পাঁচটি স্তবকে বিন্যস্ত। প্রতিটি স্তবকে মোট চারটি করে পক্তি রয়েছে। 'পরবাসী' কবিতাটির প্রথম
তিন স্তবকে কবি অতীতের স্মৃতিচারণা করেছেন। গভীর বনভূমির মধ্যেকার আলো-অন্ধকারের পথ, রাতের আলোয় জ্বলতে থাকা বন্যজন্তুর
চোখ, ছোট্ট খরগোশ, বনময়ূর, হরিণ আর চিতা-অধ্যুষিত নিবিড় অরণ্য, ছন্দে বয়ে চলা নদী আজও তাঁর স্মৃতিতে জীবন্ত। পরবর্তী দুটি স্তবকে কবি ফিরেছেন বর্তমানের বাস্তবতায়। সেই সুন্দর অরণ্যপ্রকৃতি আর প্রাণচঞ্চল গ্রামগুলি আজ হারিয়ে গেছে। সেখানে শুষ্ক বাতাসের বয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে কবি নিজের হাহাকার প্রকাশ করেছেন। নাগরিক সমৃদ্ধির নেশায় শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ তার আদি বাসস্থান প্রকৃতিকেই ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে। হারিয়ে গেছে বনভূমি। গ্রাম তার সমস্ত প্রাণচাঞ্চল্য হারিয়ে হয়ে পড়েছে নিঃস্ব, তৈরি হয়নি কোনো আদর্শ শহরও।
বিস্মিত ও বেদনার্ত কবি শেষ স্তবকে তাঁর চরম ক্ষোভ আর অভিমানকে শাণিত প্রশ্নের আকারে তুলে ধরেছেন। মানুষ কেন এখনও এই বিপন্ন, সংকটময় পরিস্থিতিতেও নিজেদের অসহায় মনে করে নীরব রয়েছে। এই দেশের নদী, গাছ, পাহাড়ের মর্যাদা রাখতে তারা কেন সোচ্চার হচ্ছে না ! কবির জানতে ইচ্ছে করে তিনি হারিয়ে যাওয়া প্রকৃতির সন্ধানে নিজভূমে পরবাসীর মতো আর কতদিন ঘুরে বেড়াবেন?
৫.৪ ‘পরবাসী' কবিতাতে কবির ভাবনা কেমন করে এগিয়েছে তা কবিতার গঠন আলোচনা করে বোঝাও।
উত্তর: স্মৃতিচারণা: কবি বিষ্ণু দে রচিত ‘পরবাসী' কবিতাটির প্রথম তিনটি স্তবকে রয়েছে কবির স্মৃতিচারণা। তাঁর স্মৃতিতে জেগে উঠেছে অতীতের অরণ্যপ্রকৃতি ও গ্রাম্য সৌন্দর্যের ছবি। সেখানে প্রকৃতির মধ্যে ভারতীয় নৃত্যকলার বিভিন্ন শৈলীকে খুঁজে পেয়েছেন তিনি। আলোছায়াময়। অরণ্যপথ যেন নাচের তালে তালে এগিয়ে গেছে এই কবিতায়। রাত্রির অন্ধকারে বন্যজন্তুর চোখ জ্বলে ওঠা বা ছোট্ট খরগোশের নেচে নেচে চলার মধ্যেও একটা ছন্দের প্রভাব লক্ষ করেছেন কবি। যখন হঠাৎ ময়ূর মনের আনন্দে নেচে উঠেছে, তার মধ্যে কবি ভারতীয় নৃত্যকলা কত্থকের রূপকে দেখেছেন। কবির মন সেই নাচের ছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে নদীর কুলকুল ধ্বনিতে ছুটে যাওয়ার ছন্দকে। নিরীহ হরিণের জল খাওয়ার দৃশ্য কবিকে যেমন আপ্লুত করেছে, তেমনই হিংস্র চিতার চলার ছন্দ কবিকে মনে করিয়ে দিয়েছে কথাকলি নাচের কথা। বাস্তবতা: পরের দুটি স্তবকে কবি ফিরেছেন বাস্তবে। সেখানে শুধুই রুক্ষতা, অনুর্বরতার ছবি আর হারানোর হাহাকার। উন্নতির লোভে, সভ্যতার গর্বে বন ধ্বংস হয়েছে, গ্রাম মরে গেছে, বসতি গড়ে ওঠেনি, নগরের পত্তনও হয়নি। সজীব, সুন্দর প্রকৃতিকে হারিয়ে ফেলার নৈরাশ্য কবির কথায় ধরা পড়েছে।
৫.৫ কবিতাটির নাম 'পরবাসী' দেওয়ার ক্ষেত্রে কবির কী কী চিন্তা কাজ করেছে বলে তোমার মনে হয়? তুমি কবিতাটির বিকল্প নাম দাও
এবং সে নামকরণের ক্ষেত্রে তোমার যুক্তি সাজাও।
উত্তর: কবির ভাবনা: কবি বিন্নু দে মানুষের হাতে প্রকৃতির নির্বিচারে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ছবি 'পরবাসী' কবিতার তুলে ধরেছেন। তাঁর চেনা
অরণ্য আর গ্রাম্য প্রকৃতিকে তিনি এখন আর কোথাও খুঁজে পাচ্ছেন না। বনকে মানুষ নির্বিচারে ধ্বংস করেছে অথচ কোনো আদর্শ নগর সে গড়ে
ভুলতে পারেনি। শুকনো হাওয়ায় আর গাছের পাতা নেচে ওঠে না, শূন্য প্রান্তরে হাওয়া হাহাকার করে ফেরে। এই হাহাকার আসলে কবিরও। এই
অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ নীরব। মানুষের প্রতিবাদহীন এই নীরবতায় কবি অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে নিজেকে ‘নিজভূমে পরবাসী' আখ্যা দিয়েছেন।
> কবিতাটির বিকল্প নাম: কবিতাটির আমি বিকল্প নাম দিতে চাই, ‘হারানো সময়'। কবি যে সময়টিকে হারিয়ে ফেলেছেন তার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গেছে মানবসভ্যতার সোনালি অতীতও। কবিতাটির ছত্রে ছত্রে সেই হারানোর বেদনাই ফুটে উঠেছে। তাই কবিতাটির নাম আমি 'হারানো সময়'
দিতে চাই।
৬. টীকা লেখো—কথক, সেতার, কথাকলি, সিন্ধুমুনি, পণ্য।
উত্তর: কথক: উত্তর ভারতের অন্যতম ধ্রুপদি নৃত্যকলা হল কথক। লখনউ ও জয়পুরকেই এই নৃত্যের জন্মস্থান বলে উল্লেখ করা হয়ে
থাকে। এই কবিতায় ময়ূরের নৃত্য প্রসঙ্গে কবি কথক নাচের উপমাটি ব্যবহার করেছেন।
সেতার: সেতার তিনটি প্রধান তারের সমাহারে তৈরি একটি অতুলনীয় বাদ্যযন্ত্র। এই তারযন্ত্রটির গঠনে 'বীণা' যন্ত্রের প্রভাব লক্ষ করা যায়। উত্তর
এশিয়া অঞ্চল থেকে উত্তর ভারতে এই যন্ত্রটি প্রথম এসেছিল। এই কবিতায়। নদীর কুলকুল জলধ্বনি কবিকে মনে করিয়ে দিয়েছে সেতারের সুর- ঝংকারের কথা।
কথাকলি: দক্ষিণ ভারতের কেরলের নাচ কথাকলি। এই নাচের বিষয়বস্তু রামায়ণ -মহাভারত ও পুরাণের কাহিনি। সাধারণত এই নৃত্যনাট্য মন্দির-প্রাঙ্গণে বা খোলা জায়গাতেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এটি প্রধানত পুরুষপ্রধান নৃত্য। এই কবিতায় চিতার হিংস্র, শক্তিশালী ও সাহসী চলাফেরা প্রসঙ্গে এই উপমাটি ব্যবহৃত হয়েছে।
সিন্ধুমুনি: বৈশ্য বংশজাত অন্ধমুনির ঔরসে শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভজাত জনৈক মুনিকুমার হলেন সিন্ধুমুনি। ইনি সরযূ নদীর তীরে বাস করতেন। একবার যুবক বয়সে রাজা দশরথ সরযূতীরে রাত্রে শিকার করতে আসেন, তখন মুনিকুমার কলশিতে জল ভরছিলেন। শব্দটিকে হরিণের জলপানের শব্দ অনুমান করে দশরথ শব্দভেদী বাণ ছোড়েন। পিতামাতার সামনেই সিন্ধুমুনির মৃত্যু হয়। বৃদ্ধ অন্ধমুনি দশরথকে পুত্রশোকে মৃত্যুর
অভিশাপ দিয়ে চিতায় আরোহণ করেন। রামায়ণের অযোধ্যাকাণ্ডে এই কাহিনি বর্ণিত আছে। কবিতায় হরিণ-আহ্বান প্রসঙ্গে সিন্ধুমুনি শব্দট ব্যবহৃত হয়েছে।
পণ্য: পণ্য শব্দটি বিশ্লেষণ করলে পাই—পণ্ + য। পণ্ শব্দের অর্থ ক্রয়-বিক্রয় করা। আর পণ্য হল বিক্রয়যোগ্য দ্রব্য বা commodity।
৭. নীচের শব্দগুলির ধ্বনিতাত্ত্বিক বিচার করো—জ্বলে, পরবাসী, চলে, তাঁবু
উত্তর: জ্বলে—জ্বলিয়া > জ্বইল্যা > জ্বলে (অভিশ্রুতি)।
পরবাসী—প্রবাসী > পরবাসী (বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি)।
চলে—চলিয়া > চইল্যা > চলে
(অভিশ্রুতি)।
তাঁবু—তাম্বু > তাঁবু (নাসিক্যীভবন
৮. শব্দগুলির দল বিশ্লেষণ করে মুক্তদল ও রুদ্ধদল চিহ্নিত করো—নিটোল,বনময়ূর, সিন্ধুমুনি, নিজবাসভূমি, সেতার।
উত্তর: নিটোল—নি (মুক্ত) · টোল্ (রুদ্ধ)
বনময়ূর-বন্ (রুদ্ধ) ম (মুক্ত) য়র্ (রুদ্ধ )
সিন্ধুমুনি – সিন্ (রুদ্ধ) . ধু (মুক্ত) · মু (মুক্ত) · নি (মুক্ত)
নিজবাসভূমি —নি (মুক্ত) · জ (মুক্ত) · বা (মুক্ত) স (মুক্ত) . ভূ (মুক্ত) মি (মুক্ত)
সেতার—সে (মুক্ত) · তার (রুদ্ধ)
৯ . নীচের শব্দগুলি কীভাবে গঠিত হয়েছে দেখাও সোনালি, আহ্বান, বন্য, বসতি, পরবাসী।
উত্তর: সোনালি > সোনা + আলি
আহ্বান > আছে + অন
বনা > বন + য
বসতি > বস্ + তি
পরবাসী > পরবাস
১০ নির্দেশ অনুসারে বাক্য পরিবর্তন করো।
১৭.১ চুপি চুপি আসে নদীর কিনারে, জল খায়। (সরল বাকো)
উত্তর: চুপি চুপি নদীর কিনারে এসে জল খায়।
১০.২ নিটোল টিলার পলাশের ঝোপে দেখেছি। (জটিল বাক্যে)
উত্তর: যেখানে নিটোল টিলা সেখানে পলাশের ঝোপে দেখেছি।
১০.৩ চিতা চলে গেল লুব্ধ হিংস্র ছন্দে বন্য প্রাণের কথাকলি বেগ জাগিয়ে। (যৌগিক বাক্যে)
উত্তর। চিতা পুখ হিংস্র ছন্দে চলে গেল এবং সে ছন্দে বন্যপ্রাণের কথাকলি বেগ জেগে উঠল।
১০.৪ কেন এই দেশে মানুষ মৌন অসহায় ? (না-সূচক বাক্যে)
উত্তর। এই দেশে মানুষের মৌন অসহায় হওয়ার কোনো কারণ জানা নেই।
