একটি ছুটির দিন || প্রবন্ধ রচনা / AKTI CHHUTIR DIN || RACHANA
![]() |
অন্যান্য বিষয়
রচনা
একটি ছুটির দিন
সংকেত সূত্র : ভূমিকা—ছুটির তাৎপর্য-ছুটির কারণ—কিভাবে ছুটি কাটালাম- উপসংহার।
ভূমিকা:- 'মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি, আজ আমাদের ছুটি ও ভাই, আজ আমাদের ছুটি।'
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কর্মব্যস্ততা, সমস্যা সঙ্কুলতা ও নানা যন্ত্রণার মুখোমুখি উপনীত হয়ে মানুষ আজ যন্ত্রণাদগ্ধ ও বিধ্বস্ত। সমস্ত বিপন্নতা ও অস্থিরতার মধ্যে আবদ্ধ থেকে নিদারুণ মানসপীড়ন সহ্য করতে হয় মানুষকে, তাই মন বারবার ছুটি চায়। মনের ধর্মই হল সুন্দরের আহ্বানকে মেনে নিয়ে দূরে, অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে যাত্রাসুখ অনুভব করে। কর্মক্লান্তি থেকে একটি দিনের ছুটি মানুষকে পরের কাজগুলো সম্পর্কে উৎসাহ দেয়। এটা শ্বাশত সত্য যে— 'বিরাম কাজের অঙ্গ একসাথে গাঁথা/নয়নের অংশ যেন নয়নের পাতা।' ছুটি মানুষের কাজের প্রেরণা এবং আত্মার আরাম, প্রাণের শাস্তি ও মনের আনন্দ এনে দেয়। আনন্দ অভিব্যক্তিতে মানুষ সীমা থেকে অসীমে কিংবা কল্পনার পাখায় ভর করে রূপকথার দেশে যাবার বাসনায় সর্বদা উন্মুখ হয়ে থাকে। সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মানবচিত্ত বারে বারে দুর্বার দুরন্ত গতিতে এক মেরু থেকে অন্য মেরুতে, এক বিশ্ব থেকে অন্য এক বিশ্বে যাত্রা করতে চায়। বিশ্বের সমস্ত কিছুর সঙ্গে মানুষ মানস ঐক্য লাভ করে এবং অস্তিত্বের সুনিবিড় সংযোগে মানবচিত্ত লাভ করে এক ভিন্ন প্রাণের সাড়া।
ছুটির তাৎপর্য :- ছুটি গতিময় কর্মধারার মধ্যে হঠাৎ এসে যাওয়া সামরিক বিরাম মাত্র নয়। ছুটি শব্দটির একটি দার্শনিক অর্থ আছে এবং এখানে মানুষ চলার গতিছন্দ ও জীবনের প্রবাহকে আবিষ্কার করে। প্রাণের চাঞ্চল্যে চিত্তের দ্বার উন্মুক্ত করে নব আনন্দে জেগে ওঠার সুখ ছুটিকে আরো ব্যাপকতা দান করে। ছুটি একটানা কাজের মধ্যে নিছক সামান্য বিরাম নয়। ছুটি মানুষকে কেবল অবকাশ দেয় না, ছুটি চলার জন্যে একটা ভিন্ন গতিসত্তাও দান করে। ছুটি নতুন কাজের প্রেরণা দেয কিংবা অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত করার পথনির্দেশ করে। উৎসাহ, উদ্দীপনা তৈরি করে ছুটি একটা হতাশা, ক্লান্তি, ক্ষয়, ভয়, ভুল, পাপ থেকেও মানুষকে রক্ষা করে। এক একসময় কর্মাধিক্য মানুষকে শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে ক্লান্ত করে এবং অবসন্ন ভাব জাগায়। ছুটি সে দিক থেকে একটা ভিন্ন স্বাদ আনে, আর সঙ্গে আনে মুক্তির অপার বিস্ময়। নৈরাশ্যপীড়িত মানুষও নতুন করে নিজেকে ভালোবাসে এবং সবদিক থেকে পূর্ণতা পাবার অধিকারী হয়।
ছুটির কারণ :- হঠাৎ ছুটির কারণ ছিল আকস্মিক। বিদ্যালয়ে পৌঁছে জানতে পারি আমাদের বিদ্যালয় গতকাল সুরত গোল্ড কাপ জিতেছে। সারা দেশের স্কুলের ছেলেদের নিয়ে দিল্লিতে যে টুর্ণামেন্ট হয় তাতে প্রতি বৎসরই আমাদের বিদ্যালয় অংশগ্রহণ করে কিন্তু এ বৎসর সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ বৎসর প্রথম থেকেই ভীষণ ভালো খেলতে থাকে স্কুল, এবং প্রত্যাশা পূরণ করে দেশের সামনে বিদ্যালয়ের সম্মানকে
উন্নত করেছে। যারা এত পরিশ্রম করেছে, তাদের সম্মান জানাতে বিদ্যালয় একদিন বন্ধ রাখার ঘোষণা করেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। কেবল ছুটি পাওয়াতেই আনন্দ নয়, হাওড়া স্টেশন থেকে স্কুলের শিক্ষক, স্থানীয় মানুষ ও বিদ্যালয়ের বড় দাদারা গিয়ে সকলকে নিয়ে আসে। গতকালের টিভিতেও দেখেছি সেই আনন্দদায়ক মুহূর্ত।
কিভাবে ছুটি কাটালাম : - এই ছুটির সম্ভাবনা মনে মনে পোষণ করেই বিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। সবাই প্রায় জানতো—এই আনন্দ উচ্ছ্বাসকে পালন করতে প্রধান শিক্ষক মহাশয় ঠিক ছুটি দেবেন।
কিন্তু কি আশ্চর্য—কেউ অনুপস্থিত ছিল না সেদিন। সম্ভবত অভাবনীয় আনন্দের সঙ্গে নিজেকে উল্লসিত করার বাসনায় কেউ অনুপস্থিত থাকার কথা ভাবতে পারেনি। বাঁধ ভাঙা আনন্দে আমরা সবাই ভেসে গেছি, এ যেন বিশ্ব জয়। ছুটি পেয়েও বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা নেই। আমরা কয়েকজন মিলেমিশে বিদ্যালয়ের সামনের মাঠে বসে গল্প করতে থাকি। কাপটা সম্পর্কে নানা মন্তব্য শুনতে পাই। কতদিন এখানে থাকবে, গতবছর কোন্ রাজ্যের কোন্ বিদ্যালয় কাপ পেয়েছিল ইত্যাদি। কে কেমন করে গোল করেছিল, খেলোয়াড়রা কোথায়, কেমন
ছিল। শিক্ষক চঞ্চলবাবু ও প্রদীপবাবু কিভাবে ছাত্রদের উৎসাহ দিতেন এবং খেলার মাঠে উদ্দীপ্ত করেছেন। এমনকি ফেয়ার প্লে ট্রফিটাও এ বছর আমাদের বিদ্যালয়ই পেয়েছে। এইসব গল্পে ও নানা মন্তব্যে বেলা গড়িয়ে বিকেল। টিফিন খাওয়ার কথাই ভুলে গেছি। পরে ভাগ করে টিফিন খেলাম। স্বর্ণাভ ‘সুতৃপ্তি' থেকে সন্দেশ আনলো সবার জন্যে—সে এক 'নব আনন্দে জাগো' অবস্থা। মাঠ ছাড়িয়ে রোদ নেমেছে পাশের দোষাল বাগানে। হঠাৎ একটা দমকা শীতের বাতাস চলে এলো। ছুটিটা ভিন্নভাবে
অতিবাহিত হল – যা এর আগে কখনো হয়নি।
উপসংহার :- ছুটির মধ্যে কোন ব্যস্ততা নেই, নেই কোন নির্দেশ বা অন্যায় করলে বকুনি। ক্লান্তি
সব সরে যায়, কাজে আসে নতুন প্রেরণা। প্রতিদিনের নিয়ম ও তার বিচিত্র আয়োজনে ছুটির দিনে একটুও স্থান পায় না। প্রাত্যহিকতার মধ্যে আমরা বড় সঙ্কীর্ণ ও ব্যাক্তিগত। কিন্তু ছুটির দিনে আমরা যথার্থই উদার ও প্রশস্ত। গত সপ্তাহ ক্লাসের তাড়ায় ও পড়ায় বড় ক্লান্ত ছিলাম কিন্তু একটা দিনের ছুটি আবার উৎসাহ জাগালো। জীর্ণ পুরাতনকে ত্যাগ করে সুন্দরের আরাধনাতেই মানবজীবনের পূর্ণতা। তাই সমস্ত ভয়-ভুল-ক্লান্তি-ক্ষয়কে সরিয়ে একটা দিনের অবসর অপার মুক্তির ঐশ্বর্যনয় আনন্দ অভিব্যক্তি দান করে মানুষকে। একটানা কাজ যেমন ক্লান্তি আনে তেমন একটানা ছুটিও ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে ছুটি পাওয়ার মধ্যে যথার্থই আনন্দ থাকে এবং এই আনন্দকে বলে বোঝানো যায় – অস্তিত্বের অনুভূতি দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। মন ছুটি চায় সমস্ত বন্ধন থেকে নিজেকে যুক্ত করে বিমুগ্ধ জগতের মাঝে আর বিশ্বকে সন্ধান করতে এবং এখানেই মানব জীবনের সমস্ত আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা মেলে।