তোমার প্রিয় গ্রন্থ || প্রবন্ধ রচনা / Tomer piriti granatha || prabandha rachana - school book solver

Friday, 27 June 2025

তোমার প্রিয় গ্রন্থ || প্রবন্ধ রচনা / Tomer piriti granatha || prabandha rachana

 



প্রবন্ধ রচনা

তোমার প্রিয় গ্রন্থ

 অনুরূপ প্রবন্ধ :

একটি স্মরণীয় বাংলা বই।


সংকেত সূত্র ঃ ভূমিকা : প্রিয়গ্রন্থ 'পথের পাঁচালী'—বিভূতিভূষণের দেশকাল-বিভূতিভূষণের জীবনাদর্শ—'পথের পাঁচালীর' কাহিনী সংক্ষেপ—নায়ক অপু ও তার পরিবারবর্গ—অপুর মানসলোক—উপন্যাসটির আঙ্গিক—নামকরণ ও ভাববস্তু-উপসংহার।


ভূমিকা : প্রিয় গ্রন্থ

'পথের পাঁচালী' :- 

কথায় বলে, 'ভিন্নরুচিহিঃ লোকাঃ'—অর্থাৎ ব্যক্তিভেদে রুচির পার্থক্য দেখা যায়।

কাজেই আমার যেটা প্রিয়, সেটা সকলের প্রিয় না হতেও পারে। তবে আমার যে-টি প্রিয় গ্রন্থ, তা শুধু আমার নয়, অনেকেরই প্রিয় এবং বাংলা সাহিত্যে তা এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের “পথের পাঁচালী”।



বিভূতিভূষণের দেশকাল :- বিভূতিভূষণের প্রথম উপন্যাস “পথের পাঁচালী” প্রকাশিত হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে।

সময়টা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তি এক ক্রান্তিকাল। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ইউরোপের জনজীবনে দেখা দিয়েছে মানবতার কল্যাণবোধে অবিশ্বাস, হতাশা, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের জ্বালা। পুরোনো মূল্যবোধগুলি দ্রুত পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। জীবনের এই অবক্ষয়ের ছবি ওদের দেশের সাহিত্যে প্রতিফলিত হল এবং ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে তারই প্রভাব পড়ল আমাদের বাংলা সাহিত্যে। তদানীন্তন বাঙালি লেখক এবং কবিরা অনেকেই এই যুগপ্রভাবের শিকার হলেন। এমনকি যোগক্ষেম রবীন্দ্রনাথও তা দেখে বিচলিত হয়ে পড়লেন। বিভূতিভূষণ এই সংশয়বিক্ষুব্ধ হতাশা-ক্ষিন্ন যুগের সন্তান, কিন্তু তিনি যে সাহিত্য রচনা করলেন তা যুগের হয়েও এক যুগাতীত আবেদনে সমৃদ্ধ হয়ে উঠল।



বিভূতিভূষণের জীবনাদর্শ :- বিভূতিভূষণের এই আবির্ভাবকে উপলক্ষ্য করে সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখলেন— “সেই সময় আশ্চর্য ‘পথের পাঁচালী' নিয়ে বিভূতিভূষণের আশ্চর্যতর অভ্যুদয়।

...এত সমস্যা, এত সংঘাত, এমন জটিল আত্মবিকলন-

–এ সবের বাইরেও যে এখনো অম্লান আনন্দের জগৎ আছে.... 'পথের পাঁচালী' তারই বার্তা বহন করে আনল।”

আসল কথা, দুঃখ দারিদ্র্য কি জিনিস বিভূতিভূষণ তা মর্মে মর্মে জানতেন; কারণ দরিদ্র মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিনি দুঃখি সন্তান। কিন্তু দুঃখকে

জীবনের শেষ কথা না বলে তিনি দুঃখের সমুদ্র মন্থন করে অমৃতপান করতে চেয়েছিলেন। এইজন্য অনেকের কাছে তিনি জীবন পলাতক

লেখক হিসেবে নিন্দিত। অথচ এই ধারণাটা যে কত ভুল তা আমাদের আলোচ্য ‘পথের পাঁচালী' উপন্যাস বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায়।




পথের পাঁচালীর কাহিনী সংক্ষেপে :- গ্রন্থটির প্রধান উপজীব্য হল নিভৃতপ্রাণ বাংলার একটি ভদ্র অথচ দুঃস্থ পরিবারের জীবনকাহিনী। এই পরিবারের কর্তা হরিহর, গৃহিনী সর্বজয়া এবং তাদের দুটি সন্তান অপু ও দুর্গা। এদের প্রতিবেশী হিসেবে আছে কোন্দলপ্রিয়া সেজঠাকরুণ, মূর্খ গোকুল, রাজু রায়, দীনু পালিত, গুরু মহাশয়, সতু, রাণী, আতুরী ডাইনী, দাসীঠাকরুণ প্রভৃতি বিচিত্র চরিত্র, এমনকি সবশেষে জমিদারগৃহের কন্যা লীলা। এরা সকলেই যেমন মূল কাহিনীর সঙ্গে এসে অনায়াসে যুক্ত হয়েছে, তেমনি প্রত্যেকে নিজ নিজ সুখ-দুঃখ, ক্ষুদ্রতা-দীনতা, আনন্দ-অভিশাপ নিয়ে এই বৃহদায়তন উপন্যাসের বিস্তৃত বর্ণবহুল চিত্রপটখানি সমৃদ্ধ করে তুলেছে।

প্রতিটি নরনারী তাদের দোষগুণ নিয়েই এ উপন্যাসে রূপায়িত হয়েছে ; কেউ কল্পিত অতিমানব বা নরপিশাচরূপে চিত্রিত হয়নি। বাস্তবকে বিভূতিভূষণ তার স্বরূপেই

দেখেছেন।



নায়ক অপু ও তার পরিবারবর্গ :- এ উপন্যাসের মূল চরিত্র কিন্তু অপু। অপুর বাবা হরিহর রায় সহায় সম্বলহীন দরিদ্র ব্রাহ্মণ। পৌরোহিত্য করে সামান্য যা কিছু পায় তাতে সংসারের কিছুই সাশ্রয় হয় না। পৈতৃক অধিকারসূত্রে সে কয়েকখানি গ্রন্থ পেয়েছিল। সেই গ্রন্থমধ্যে যে উচ্চ জীবনাদর্শের কথা ছিল তদনুরূপ জীবনযাপনের স্বপ্ন সে নিজেও দেখেছিল এবং তার স্ত্রী সর্বজয়াকেও দেখিয়েছিল; কিন্তু সেই জীবনগঠনের পথ তার জানা ছিল না। তাই মাঝে মাঝেই সে ভাগ্যান্বেষণের জন্য গৃহত্যাগ করেছে এবং ভবঘুরের মত ঘুরে ঘুরে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। হরিহরের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে তার অচল সংসারটিকে কোন রকমে সামলেছে স্ত্রী সর্বজয়া। পুত্র অপু এবং কন্যা দুর্গার দায়দায়িত্ব তো ছিলই, তার সঙ্গে আরও একটি অতিরিক্ত বোঝা ছিল হরিহরের দূর সম্পর্কের বিধবা দিদি ইন্দিরা ঠাকরুণ। নিজের সন্তান দু'টির ক্ষুধার অন্ন যখন সে জোটাতে জেরবার তখন এই অবাঞ্ছিত আপদটির প্রতি সে সদয় হতে পারেনি।

ক্ষুধার এক মুঠো অন্ন না দিয়ে তাকে বিতাড়িত করার পর পথে পড়ে যখন ইন্দিরা ঠাকরুণের সকরুণ মৃত্যু ঘটলো, তখন সর্বজয়াকে ক্ষমা করা যায় না। তবু তার/পরিস্থিতিগত অক্ষমতা আমাদের ভাবায়। বিশেষত দুর্গার মৃত্যুর রাত্রিতে সে অপরিসীম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। অবশেষে জমিদার গৃহের রাঁধুনীরূপে সে নিজে এবং দাসীপুত্র হিসেবে অপু যখন লাঞ্ছিত হয়েছে, তখন এই হতভাগিনী ননদটির জন্য তার চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠেছে।

অপুর শৈশবসঙ্গিনী তার দিদি দুর্গা। ভাইটির জন্য এই পাড়াবেড়ানী দিদির চিন্তা ও ভালবাসার অন্ত নেই। বনজঙ্গলে ঘুরে ঘুরে আম, আমড়া, তেঁতুল—যা কিছু পাওয়া যায় সব এনে হাজির করেছে অপুর কাছে। হারানো বুধি গাইয়ের সন্ধানে বেরিয়ে রেলগাড়ি দেখার জন্য ভাইবোনের অভিযাত্রার যে দৃশ্য বিভূতিভূষণ চিত্রিত করেছেন তা অবিস্মরণীয়। অবশেষে কিশোরী দুর্গার মনে নীরেনের সম্পর্কে এক লজ্জারুণ ভবিষ্যৎ জীবনের স্বপ্নচিত্র সঞ্চিত হতে শুরু করেছে। এই প্রারম্ভিক সম্ভাবনার মধ্যেই মৃত্যু এসে দুর্গাকে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এই অসাধরণ পল্লীবালিকার চরিত্রটিকে অনেকে Wordsworth-এর Lucy-র সঙ্গে তুলনা করেছেন।



অপুর মানসলোক;- অপু চরিত্রের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য তার অকৃত্রিম প্রকৃতিপ্রীতি। এই প্রকৃতিপ্রীতির মন্ত্রে দীক্ষা দান করার জন্য দুর্গার প্রধান প্রয়োজন ছিল। সেই অনুপূরকের কাজটি শেষ হতেই লেখক যেন কাব্যের প্রয়োজনে তাকে বিদায় দিয়েছেন। দুর্গার মৃত্যুর পরে অপুর নিশ্চিন্তপুরের দিন শেষ হয়ে গেছে। তাকে সংকীর্ণ সীমানার গণ্ডী অতিক্রম করে পাড়ি দিতে হয়েছে মহত্তর ও বৃহত্তর জগৎ এবং জীবনের আহ্বানে।

সে শৈশবে একদিন শুনেছিল প্রসন্ন গুরু মহাশয়ের কন্ঠে জনস্থান মধ্যবর্তী প্রস্রবণ গিরির কথা, বড় হয়ে মাসিক পত্রিকায় পড়েছিল ধনরত্নসমেত ডুবোজাহাজের কথা; মহাভারতের ভাগ্যবিড়ম্বিত কর্ণ তার মনকে করেছিল অতীত সঞ্চারী। বাবার সঙ্গে আমডোব যাওয়ার সময় সে পরিচিত জগতের মধ্যে পেয়েছিল এক অনির্বচনীয় অচেনার আনন্দ। এ ছাড়া মায়ের মুখে রূপকথার গল্প শুনে সে জেনেছিল শ্যামলঙ্কার দেশ, বেঙ্গমা-বেঙ্গমীর গাছের নীচে নির্বাসিত রাজপুত্রের কথা, তারপর তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে অজানা, অসম্ভবের স্বপ্নরাজ্য। অপু সেই স্বপ্নরাজ্যের চিরপথিক। বাবার মৃত্যুর পর বাস্তবের কঠিন মাটিতে দাঁড়িয়েও এই স্বপ্নের মায়াকাজল অপুর চোখ থেকে মুছে যায় নি।


উপন্যাসটির আঙ্গিক

:- পথের পাঁচালীর ভাষায় আছে এক সহজ সরল সঙ্গীতময় চিত্রধর্মীতা। এর আঙ্গিকে আছে কথকরীতি। কোথাও চরিত্রের দ্বন্দ্ব বা ঘটনার কুটিল আবর্ত নেই। এর প্রতিটি চিত্র ও চরিত্রকে লেখক অনায়াসনৈপুণ্যে সাজিয়ে দিয়েছেন।

মূল কাহিনীকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করেছেন বিভূতিভূষণ—‘বল্লালী বালাই', ‘আম আঁটির ভেঁপু' ও 'অক্রূর সংবাদ'। বল্লাল সেনের আমলে কৌলীন্য প্রথার প্রবর্তন। তারই বলি বালবিধবা ইন্দির ঠাকরুণ। 'আম আঁটির ভেঁপু'র পর্যায়ে অপু-দুর্গার শৈশবলীলা এবং 'অক্রুর সংবাদ' অংশে অঙ্কুরের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের মথুরায় গমন অর্থাৎ বাল্যলীলা সমাপনান্তে কৃষ্ণের কর্মজীবনের সূচনা দ্বারা অপুর যৌবনারম্ভের আভাস দেওয়া হয়েছে। এদিক থেকে অভিযাগুলি তাৎপর্যপূর্ণ।



নামকরণ ও ভাববস্তু:- তবে সর্বাধিক তাৎপর্যবহ গ্রন্থের শিরোনামটি। পথের পাঁচালীর অর্থ পথের গান। পাঁচালী হল গ্রামা সঙ্গীত। কিন্তু অখ্যাত, অবহেলিত নিশ্চিন্তপুরের পটভূমিতে বিভূতিভূষণ শুনিয়েছেন মহাজীবনের গান। এক একটি খণ্ড জীবন মিলে গঠিত হয় মহাজীবন। সে জীবনের মৃত্যু নেই; তা অনন্ত, নিত্য, শাশ্বত। সে "দেশ ছেড়ে বিদেশের দিকে, সূর্যোদয় ছেড়ে সূর্যাস্তের দিকে, জানার গণ্ডী এড়িয়ে অপরিচয়ের উদ্দেশে....

দিনরাত্রি পার হয়ে, জন্মমরণ পার হয়ে, মাস, বর্ষ, মন্বন্তর, মহাযুগ পার হয়ে চলে... চলে... চলে... এগিয়েই চলে –” অপু শুনেছে এই মহাজীবনের গান। তাই 'পথের পাঁচালী'র শেষে যে জীবন লাঞ্ছিত হয়, ধূলিধূসরিত হয়, “অপরাজিত”

উপন্যাসে সেই জীবন আবার উজ্জীবিত হয়, শুরু হয় তার অনত্ত পথ পরিক্রমা.... ।



উপসংহার: আসলে অপুর স্বপ্ন ছিল বিভূতিভূষণের চোখে। এ উপন্যাসে স্রষ্টা এবং সৃষ্টি একাত্ম হয়ে আছে। আটপৌরে অচঞ্চল পল্লীজীবনের মধ্যে যে এক বৈচিত্র্য আছে, বনকলমী আর ঘেঁটুফুলের মধ্যে যে এত.মাধুর্য আছে, মেটে আলু আর বুনো চালতা যে এত সুস্বাদু তা ‘পথের পাঁচালী' না পড়লে জানা যেত না। জানা যেত না, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটি করে হারানো শৈশব আছে। রবীন্দ্র সাহিত্যের পরেও যে প্রকৃতিলীন এমন শান্তরসাস্পদ মানবজীবন আছে পথের পাঁচালী না পড়লে অজ্ঞাতই থেকে যেত। আজকের এই অশান্ত জ্বরাতপ্ত ত্বরাতপ্ত পৃথিবীতে “পথের পাঁচালী” তাই আমার প্রিয়তম ও শ্রেয়তম গ্রন্থ।