পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার || প্রবন্ধ রচনা / poribesh dushn o tar protikar || prabandha rachana - school book solver

Monday, 30 June 2025

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার || প্রবন্ধ রচনা / poribesh dushn o tar protikar || prabandha rachana

 


প্রবন্ধ রচনা

পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার 

[অনুরূপ প্রবন্ধ :

(১)বিশ্বপরিবেশ ও মানবসমাজ ।

(২) বিশ্বপরিবেশ ভাবনা ।]


সংকেত সূত্র: ভূমিকা—দূষণের কারণ— দূষণের প্রতিকর উপসংহার।


ভূমিকা :- “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,

তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো”।

এ প্রশ্ন শুধুমাত্র রবীন্দ্রনাথের নয়, আজ বিশ্বের প্রায় প্রতিটি সচেতন মানুষের এই প্রশ্ন। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ নিয়ে আমাদের চারিদিকের যে পরিবেশ, তা প্রতিনিয়ত ভীষণভাবে দূষিত হচ্ছে। পানীয় জল এবং জীবনদায়ী যে অক্সিজেনপূর্ণ বাতাস তা আর বিশুদ্ধ থাকছে না। স্বার্থপর এবং অপরিণামদর্শী মানুষের যথেচ্ছ ব্যবহারে এই জল ও বায়ুর দূষণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া দূষিত হচ্ছে মাটি, মাটি থেকে উৎপন্ন ফলমূল, খাদ্যদ্রব্য। যে মধুর শব্দতরঙ্গ আমাদের শ্রুতিকে তৃপ্তি দেয়, চিত্তকে  বিমুগ্ধ করে, সেই শব্দও দূষিত হচ্ছে। এই সঙ্গে দূষিত হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্যাবলী। মোট কথা এই মহাবিশ্বের পরিবেশ প্রতিমুহূর্তে দূষিত হয়ে আমাদের জীবনধারণকে করে তুলছে সংঘাতময় ও সংকটপূর্ণ। পৃথিবীর পরিবেশ বিজ্ঞানীরা তাই মানুষ তথা জীবজগতের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চিন্তিত। পরিবেশ দূষণের এই ভয়াল পরিণাম থেকে মুক্তি পাবার জন্য রাষ্ট্রসংঘ তাই প্রতিটি মানুষকে সচেতন করতে চাইছেন এবং প্রতিবছর ৫ জুনকে 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস' হিসেবে পালন করতে বলছেন।


দুষণের কারণ :- পরিবেশ দূষণের প্রকৃতিকে বিজ্ঞানীরা দু'ভাগে ভাগ করেছেন— প্রাকৃতিক কারণ এবং মনুষ্যসৃষ্ট কারণ। সৃষ্টির আদিতে কয়েকটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় তো মানবজীবনের প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। বন্যা, দাবাগ্নি, ঘূর্ণিঝড়, পরাগকোষ বিদীর্ণ হয়ে ছড়িয়ে

যাওয়া প্রভৃতি দূষণের প্রাকৃতিক কারণগুলির অন্যতম ছিল। কিন্তু মানুষ যেদিন অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করতে শিখল, সেদিন থেকে মানবসভ্যতার যেমন প্রথম পদাঙ্ক সূচিত হল, তেমনি তার জীবনধারণের অন্তরায়ও মানুষ প্রথম সৃষ্টি করল। পরিবেশ প্রাকৃতিক কারণে দূষিত হলে তা প্রকৃতির দ্বারাই আপনা আপনি শোধিত হত, কিন্তু মানুষ যখন পরিবেশকে দূষিত করতে শুরু করল, তখন সে প্রতিষেধক বা প্রতিকারের কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করল না। এইভাবে আজ আমরা দুষিত পরিবেশের শিকার হচ্ছি। অগ্নিপ্রজ্জ্বলনের দ্বারা বায়ুজগৎ খুব বেশি ভাবে দূষিত হয়। অগ্নি যেমন আমরা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে প্রজ্জ্বলিত করি, তেমনি যন্ত্রসভ্যতার প্রসারের ফলে নানান

কলকারখানাতে আগুন জ্বালানো হয়। ফলে কলের চিমনিনিঃসৃত ধোঁয়ার কুণ্ডলী শিল্প নগরীর আকাশে যে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে তাতে বায়ুমণ্ডল দূষিত হয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনের

থার্মাল প্ল্যান্টগুলিও এইভাবে বায়ুদূষণ করে। ঘন ঘন রকেট নিক্ষেপ এবং বিমান চলাচলের ফলে বায়ুমণ্ডলে 'ওজন' গ্যাসের স্তরে শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে সূর্যের "আলট্রা ভায়োলেট রে বা অতি বেগুনী রশ্মি ভূ-পৃষ্ঠে অবাধে পতিত হয়ে উদ্ভিজগৎ ও প্রাণীজগতের প্রাণ সংহার করতে পারে। এছাড়া পরমাণু উৎপাদক দেশগুলির পরমাণু বিস্ফোরণের ফলেও বায়ু দুষিত হচ্ছে। দুষিত বায়ুতে নানা রোগজীবাণু জন্মাতে পারে।

দূষিত বায়ুতে সালফার, নাইট্রোজেন, কার্বন মনোক্সাইড প্রভৃতি গ্যাসের অবস্থিতির ফলে প্রাথমিক অবস্থায় চোখ জ্বালা করে এবং চোখে জল পড়ে। পরে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়।

এছাড়া শ্বাসকষ্ট হয়, হৃদরোগ, ক্ষয়রোগ এমনকি ক্যানসারও হতে পারে। তাছার-মাতৃজঠরে সুস্থ সন্তানের জন্মও ব্যাহত হতে পারে। গ্যাস চেম্বারের গ্যাস মানুষের-অসতর্কতার জন্য কিভাবে জনবসিতপূর্ণ সমৃদ্ধ শহরকে মুহূর্তে মৃত্যুর শ্মশানে পরিণত করতে পারে তার করুণ দৃষ্টান্ত মধ্য প্রদেশের ভোপাল। হাওড়ার দাসনগরেও ছোটবাটো অনুরূপ দুর্ঘটনা সম্প্রতি ঘটে গেল। আজকাল ব্যাপকভাবে বৃক্ষচ্ছেদনের জন্যও অক্সিজেনদায়ী বৃক্ষের অভাবে আমাদের পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।

বায়ুর সঙ্গে পানীয় জলও দূষিত হচ্ছে নানাভাবে। গঙ্গাতীরবর্তী বড় বড় শহরের নালা নর্দমা দিয়ে বর্জ্য পদার্থ গঙ্গার জলে পড়ে জলকে দূষিত করছে। এছাড়া রোগীর মলমূত্রমাখা কাপড়-চোপড় কাচা ও গবাদি পশুর গা ধোয়ানোর ফলে পুষ্করিণী এবং জলাশয়ের জল দূষিত হতে পারে। মাটির উপরের স্তরের দূষিত পদার্থ বর্ষার জলের সঙ্গে চুঁইয়ে মাটির ভিতরে নেমে অগভীর নলকূপের জলকেও দূষিত করে। এই জল পানে আমাশয় কলেরা প্রভৃতি রোগ হতে পারে।

পানীয় জলের সঙ্গে খাদ্য দূষণ মারাত্মকভাবে আমাদের জীবনকে পঙ্গু করেছে। দূরে,-শিশুর খাদ্যে এবং নানা প্রকার মশলাপাতিতে তা ভেজালের দ্বারা দূষণ চলছেই, কিন্তু শাক-সব্জী ও ফলমূলে দূষণ চলছে তার জন্ম থেকেই। বাজারের যত বড় বড় সতেজ সবুজ বাহারী পটল, বেগুন, কপি, মূলো ইত্যাদি—সবের মূলে আছে বহুবিধ কীটনাশক ওষুধের তীব্র বিষক্রিয়া। আজকের উচ্চফলনশীল সমস্ত ধানের চারা থেকে পাকাবান কেটে আনা পর্যন্ত ঐ বিষাক্ত ওষুধ। অধিক পরিমাণে নাইট্রোজেন এবং ওষুধ না দিলে কিছুই হবে না। আমরা প্রায় জেনে শুনেই এই বিষ খাচ্ছি।

এই সঙ্গে আছে শব্দ দূষণ। ট্রেন ও কলকারখানার ভোঁ, মোটর-ট্রাকের উচ্চকিত হর্ণ, টেপরেকর্ডার ও লাউডস্পীকারের বিকট চিৎকার মানুষের কর্ণপটহে আঘাত করে তার শ্রবণশক্তি বিলুপ্ত করে তাকে বধির করে দিতে পারে। মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতার মত নগরে এই দূষণ এক ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। বৃদ্ধ, শিশু, পরীক্ষার্থী, রোগী বেশি করে

এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার সচেতন হয়ে শব্দাঙ্ক তাই ৬৫ ডেসিবেলে বেঁধে দিয়েছেন। কিন্তু অসচেতন মানুষ প্রায়ই এই নিয়ম মেনে চলছে না। সঙ্গীতের মৃদু মধুর সুর যেমন রোগীর দেহে প্রাণ সঞ্চার করতে পারে, তেমনি সেই সুরের বিকট আওয়াজ যে তার প্রাণঘাতী হতে পারে তা আমাদের জানা উচিত।

দৃশ্যদূষণের দিকটিকেও উপেক্ষা করা যায় না। দীর্ঘক্ষণ ধরে রঙিন টি. ভি. শুধু নয়, যে কোন টি. ভি. দেখারই কুফল আছে। এর বিজ্ঞাপনের রঙের বলত, দ্রুত চমক, কুরুচিপূর্ণ দৃশ্য, ক্যাটকেটে রঙের দেওয়াল লিখন, বিকৃত বিজ্ঞাপন প্রভৃতি আমাদের-দৃষ্টিশক্তিকে পীড়িত করে, স্নায়ুতন্ত্রীতে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। স্বাস্থ্যের পক্ষে সবই ক্ষতিকর।


দূষণের প্রতিকার :-  এই সর্বাত্মক পরিবেশদূষণের হাত থেকে আমাদের রক্ষার উপায় চিন্তা করার প্রয়োজন আজ খুব বেশি। দেখা যাচ্ছে কাগজে কলমে, উৎসব-অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়ে যত কথা বলা হচ্ছে, কাজে ফল হচ্ছে সামান্যই। মানুষ সচেতন ও মানবতাবোধসম্পন্ন না হলে কোন পরিকল্পনাই কার্যকরী হবে না। দূষণের কারণগুলি যাতে দূর হয় তা দেখতে হবে এবং যেখানে প্রকল্পগুলিকে বাদ দেওয়া যাবে না সেখানে প্রতিকার ও প্রতিষেধকের সুষ্ঠু ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। পারমাণবিক বিস্ফোরণ, রকেট নিক্ষেপ প্রভৃতি বন্ধ করে, অরণ্য উচ্ছেদ বন্ধ করে বনসৃজনের ব্যবস্থা-করতে হবে। এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করার জন্য যা দরকার তা আন্তরিকতার সঙ্গে, প্রয়োজন হলে প্রশাসনিক আইন দ্বারা জোর করে করতে হবে।



উপসংহার;- পরিবেশকে দূষণমুক্ত করতে না পারলে আমাদের এই পরিচিত অতিপ্রিয় পৃথিবী একদিন ফল-শস্য উৎপাদন করতে ভুলে যাবে, তার ঋতুচক্রের আবর্তনে ঘটবে নানা বিপর্যয় এবং শেষ পর্যন্ত সমূহ ধ্বংসের হাত থেকে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে উঠবে।