প্রতিদিনের জীবনে বিজ্ঞান || রচনা/ protidiner jibane biggan || rachana - school book solver

Saturday, 7 June 2025

প্রতিদিনের জীবনে বিজ্ঞান || রচনা/ protidiner jibane biggan || rachana

 


প্রতিদিনের জীবনে বিজ্ঞান

অথবা প্রাত্যহিক জীবনে বিজ্ঞান


প্রবন্ধ রচনা


সংকেত সূত্র : ভূমিকা—বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সূচনা— প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা—মারণরোগের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের নিরন্তর অভিযান - বিনোদনের ইতিহাসে বিজ্ঞান—দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান—উপসংহার।

ভুমিকা-বর্তমান যুগকে আমরা অনায়াসে বিজ্ঞানের যুগ নামে অভিহিত করতে পারি। গত
একশো বছরে পৃথিবীতে বিজ্ঞানের যে অভূতপূর্ব উন্নতি আমাদের চোখে পড়েছে এবং মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেকে বিজ্ঞান যেভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে, তাকে একথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এবং তারপর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে এখন আমরা বিজ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। শহুরে সভ্যতা যত উন্নতিলাভ করবে, আমরা ততই বিজ্ঞানের ওপর আরে ঋণী হয়ে পড়ব।
তাই এখন অনায়াসে বলা যেতে পারে যে আমাদের এই যুগে আমরা বিজ্ঞানকে ছাড়া এক মুহূর্তও চলতে পারি না, গতিময় এই পৃথিবীতে বিজ্ঞান মানুষকে নানাভাবে উন্নত
করেছে। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলশ্রুতিতে আমাদের জীবন আরো স্বচ্ছন্দ হয়ে উঠেছে।
বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট বিশ্বের মানবসমাজ আগের থেকে আরো বেশি উন্নত হয়েছে এবং
মৃদ্ধির চরম শিখরে উন্নীত হয়েছে।

বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সূচনা - যেদিন মানুষ প্রথম আগুন জ্বালাতে শিখেছিল, সেদিনই সভ্যতার প্রদীপশিখা জ্বলে ওঠে। ক্রমশ মানুষ দেহ আবৃত করতে, ঘর বাঁধতে, অস্ত্র ব্যবহার করতে এবং কৃষিকাজ করতে শিখেছে। এভাবেই মানবসভ্যতা ক্রমশ বিকশিত হয়ে ওঠে।
মানুষের অনন্ত জিজ্ঞাসা এবং অপরিসীম কৌতূহল চরিতার্থতার জন্যে একটির পর একটি তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। তত্ত্ব এবং তথ্যের সমন্বয়ে সাধন করেছে বৈজ্ঞানিক অভিচেতনা। মানুষ নিজের প্রয়োজনে একটির পর একটি বিষয়কে
কাজে লাগিয়েছে। এইভাবে উদ্দেশ্য সাধন করেছে। মানব কল্যাণমুখী বিজ্ঞান মানুষের দিকে আশীর্বাদের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
সভ্যতার যাত্রাপথে মানুষ আজ বিজ্ঞানের দ্বারা নানাভাবে উপকৃত হয়েছে। বিজ্ঞানের অতন্দ্র তপস্যার ফল আজ স্থলে, জলে, অন্তরীক্ষে উড্ডীন। বিজ্ঞান তার জাদুতে বনকে পরিণত করেছে সবুজ প্রান্তরে। দুরন্ত নদীর উচ্ছ্বসিত কলাধারাকে বন্দী করেছে। পাহাড়কেও অনেক সময় পদানত করতে বাধ্য করেছে। উষর প্রান্তরে জল সেচন করে সবুজ বিপ্লব ঘটিয়েছে। নিত্যনতুন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে দুরূহ কাজকে
সহজসাধ্য করে তুলেছে। বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটে গেছে নানা দিকে।

প্রযুক্তিবিদ্যার ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক চিন্তা ধারা:-
বর্তমান যুগ হল প্রযুক্তিবিদ্যার যুগ। প্রযুক্তিবিদ্যা ছাড়া আমরা একটি মুহূর্তের কথা চিন্তা করতে পারি না। এই প্রযুক্তি নানাভাবে আমাদের জীবনকে উন্নত করে তুলেছে। আগে যে কাজ করতে অনেক কায়িক পরিশ্রম করতে হত এখন আমরা অতি সহজেই সেই কাজগুলি করতে পারি। দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রযুক্তিগত দিকটি উদ্ভাসিত হয়েছে। এখন আমরা ইচ্ছে সেই ওয়াশিং মেশিনের সাহায্যে কাপড় কাচতে পারি। বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রের সাহায্যে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করতে পারি। এইভাবে আধুনিক প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে আরামপ্রদ ও বিলাসবহুল করে তুলেছে।

মারণ রোগের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের নিরন্তন অভিযান:;  বিজ্ঞান যে শুধু আমাদের জীবনকেই সুউন্নত করে তুলেছে তাই নয়, আগে যে সমস্ত
রোগে বাঁচবার কোনও আশা থাকত না, এখন সেই রোগগুলিকে অনেকাংশে পরাভূত করতে পেরেছে। এই প্রসঙ্গে আমরা কলেরা, টাইফয়েড প্রভৃতি মহামারী রোগের কথা বলতে পারি। এই পৃথিবীতে এখন প্রায় সমস্ত রোগী মানুষে করায়ত্ত হয়েছে। ঠিকমতো চিকিৎসা হলে এবং ওষুধ পড়লে সব রোগ থেকেই মানুষ সেরে উঠতে পারে। এমনকি একসময়ের দুরারোগ্য ক্যানসার ব্যাধিকেও মানুষ আজ বশীভূত করতে সমর্থ হয়েছে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটির পর একটি আবিষ্কার দেখা দিচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে যে মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে ওঠার স্বপ্নকে সফল করবে, তা আমরা অনায়াসে বলতে পারি।

বিনোদনের ইতিহাসে বিজ্ঞান ;;আধুনিক জীবন বিনোদন সর্বস্ব হয়ে উঠেছে। বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা বিনোদনের জগৎকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। দূরদর্শন অথবা রেডিও থেকে শুরু করে কমপ্যাকট ডিস্ক, রেকর্ড প্লেয়ার ইত্যাদি আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে বিনোদনের সহস্র উপকরণে ভরিয়ে তুলেছে। এর পাশাপাশি যদি আমরা পাখা
কিংবা ফ্রিজের মতো বিলাসবহুল অথচ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির কথা বলি তাহলে বুঝতে পারব যে কেন বিজ্ঞানকে আমাদের চরম বন্ধু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞান;;
দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অবদান কী অপরিহার্য তা একটি দিনের ওপর দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যাবে। সকালে শয্যা ত্যাগ করার মুহূর্ত থেকে রাতে শয্যা গ্রহণ করার মুহূর্ত
পর্যন্ত আমরা বিজ্ঞানের হাতে বন্দী। রাতে যখন আমরা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকি তখনো আমরা পাখার হাওয়া খেতে থাকি। এক্ষেত্রেও বিজ্ঞান আমাদের সেবা করে চলেছে। দিনের পর্বে ঘড়ি আমাদের সময় সঙ্কেত জানিয়ে দেয়। রান্নার জন্যে আমরা গ্যাস বা ইলেকট্রিক ওভেন ব্যবহার করে থাকি। অল্প সময়ে যাতে সব রান্না সমাধা করা যেতে পারে সেইজন্য নিত্যনতুন মাইক্রো ওভেন বা কুকিং রেঞ্চ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। শীতকাল হলে আমরা স্নানের জল গরম করার জন্যে ওয়াটার হিটারের সাহায্য নিয়ে থাকি।
দিনের দ্বিতীয় পর্বকে আমরা কর্মব্যস্ততার পর্ব নামে চিহ্নিত করতে পারি। এই সময় ছাত্র-ছাত্রী, অফিস যাত্রী প্রভৃতি সকলেই নিত্য নিত্য গন্তব্যস্থলে যাবার জন্যে তৎপর হয়ে ওঠেন। সেক্ষেত্রে আমাদের নানাধরনের যানবাহনের ওপর নির্ভর করতে হয়। দ্রুতগামী বাস, ট্যাক্সি, ট্রাম গাড়ি থেকে শুরু করে রেল, চক্ররেল, পাতাল রেল, রিক্সা, অটো রিক্সা, টেম্পো,আমাদের জন্যে অপেক্ষা করে থাকে।
যদি কেউ কোথাও ঠিকমতো যেতে না পারেন তাহলে আমরা ফোন করে সেই অসুবিধার কথা জানিয়ে দিতে পারি। এরপর আসে দূরসঞ্চার বিভাগের কাজকর্ম। টেলিগ্রামের মাধ্যমে দূরবর্তী জায়গাতে খবর পাঠানো যেতে পারে। এখন আবার ই-মেলের সাহায্যে অতি সহজে মনের খবর দূরে পাঠানো সম্ভব হচ্ছে। ই-কমার্স আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে নানাভাবে প্রভাবিত করছে। প্রতিমুহূর্তে আমরা কমপিউটারের ওপর নির্ভর করছি। এর পাশাপাশি সাইবার কাফেগুলির অবস্থিতিও আমাদের জীবনধারাকে একেবারে পাল্টে দিয়েছে। এই কাজগুলির সঙ্গে বিশ্ব তথ্য ভাণ্ডারের যোগাযোগ
আছে। এইভাবে আমরা ইন্টারনেটে তথ্য সার্ফিং করতে করতে সারা পৃথিবীর তথ্য ভাণ্ডারকে মুঠো বন্দী করতে পারছি। যে কোনও সংবাদ অতি সহজেই চোখের সামনে ভেসে উঠছে। এখন আর আমাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য এক গ্রন্থাগার থেকে অন্য গ্রন্থাগারে ছুটতে হচ্ছে না। অথবা ভারী ভারী বই মুখস্থ করতে হচ্ছে না । বড় বড় অফিসে দেখা যায়, প্রখর রৌদ্রের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে এয়ারকন্ডিশনার চালু হয়েছে। এটিও আমাদের জীবনকে আরামপ্রদ করে তোলে। ওপরে ওঠার জন্যে আমরা এসক্যানেটর কিংবা লিফটের ব্যবহার করে থাকি। এই দুটি জিনিসও আমাদের জীবনকে অনেকখানি বিলাসবহুল করে তুলেছে।
অবসর সময়ে আমরা টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখি কিংবা রেডিওতে কান পেতে গান কিংবা কবিতা শুনে থাকি। শীততাপনিয়ন্ত্রিত থিয়েটার গৃহে গিয়ে মনের মতো সিনেমা দেখে অবসরযাপন করি। সারাদিনের কর্মক্লান্তির পর শেষ পর্বে মানুষ ঘরে ফিরে আসে। তখন বিনোদনমূলক কাজেকর্মে ব্যাপৃত হয়ে পড়েন। এখানেও বিজ্ঞান তার কল্যাণকামী হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
টেপরেকর্ডার অথবা ভি. সি. আর কিংবা ভি. সি. ডি-র সাহায্যে আমরা সহজেই আমাদের বিনোদনের চাহিদাগুলিকে পূরণ করতে পারি।

উপসংহার :- দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের অসাধারণের অবদানের কথা আলোচনা করেও এই নির্ভরশীলতা ক্ষতিকারক দিকটির ওপর দুই একটি কথা বলব। সমাজ বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে মানুষ ক্রমশ আগের থেকে আরো বেশি যন্ত্রনির্ভর হয়ে উঠবে। তার মনের।  সুকুমার প্রবৃত্তিগুলির মৃত্যু ঘটবে। মানুষ আর আগের মতো আবেগ সঞ্জাত হবে না। ছোট ছোট অনুভূতিগুলি হারিয়ে যাবে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করবে ঐ সর্বনাশা বৈজ্ঞানিক অভিচেতনা। তা সত্ত্বেও আমাদের স্বীকার করতে হবে যে বিজ্ঞান আমাদের জীবনকে যেভাবে বিলাসবহুল ও আরামপ্রদ করার পাশাপাশি সুখ নির্ভর ও সহজ-সরল করে তুলেছে, তার ফলে আমরা আর ইচ্ছে করলেও বিজ্ঞানের ক্ষতিকারক দিকগুলির হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারব না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আরো বেশি বিজ্ঞাননির্ভর হয়ে উঠবে, এটাই হল সভ্যতার একটি মারাত্মক সত্য।