বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান মানসিকতা || রচনা / biggan o biggan manasiata || rachana - school book solver

Sunday, 8 June 2025

বিজ্ঞান ও বিজ্ঞান মানসিকতা || রচনা / biggan o biggan manasiata || rachana

 


বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান মানসিকতা
প্রবন্ধ রচনা


সংকেত সূত্র : ভূমিকা—বিজ্ঞান মনস্কতার ধারাবাহিক ইতিহাস—ডারউইনের বিবর্তনবাদ — কালমার্কসের বস্তুমূলক দ্বন্দ্ববাদ – বিজ্ঞান মানসিকতার উন্মেষ এবং বিকাশ—উপসংহার।

ভূমিকা-  বিজ্ঞান বলতে বোঝায় কোনও বিষয়ে বিশেষভাবে জ্ঞানার্জন করা। বিজ্ঞানসম্মত চেতনা থেকেই মানুষের মনের মধ্যে একধরনের মানসিকতার জন্ম হয়। যাকে আমরা বিজ্ঞান মানসিকতা বলতে পারি। কোনও জ্ঞাতব্য বিষয়কে কার্য-কারণ এবং যুক্তি দিয়ে বিশ্লেষণ করার নামই হল বিজ্ঞান চেতনা। যাকে আমরা বিজ্ঞান-মনস্কতা নামে অভিহিত করেছি। বিজ্ঞান চেতনা মানুষকে নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী করে দেয়। আমরা কোনও বিষয় সম্পর্কে পূর্ব পরিকল্পিত মতবাদ গ্রহণ করতে পারি না। অথবা অকারণে সন্দিগ্ধ চিত্তে কোনও বিষয়কে আস্বাদিত করতে পারি না।

শাস্ত্রীর আপ্তবাক্যের সাহায্যে কোনও রহস্যের বিচার ও গ্রহণ করার পরিবর্তে আমর বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং কার্যকারণ যোগসূত্রের সাহায্যে সেই রহস্যের যবনিকা উত্তরণের চেষ্টা করতে থাকি। বিজ্ঞান এই জাতীয় মানসিকতার বোধক এবং দ্যোতক বিজ্ঞান বলতে আমরা সেই বিশেষ জ্ঞানকে বুঝিয়ে থাকি যেখানে পর্যবেক্ষণ হার একটি স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। যে কোনও বিষয়ে যুক্তিগ্রাহ‍্য ব্যাখ্যা হল বিজ্ঞানের লক্ষ্য। বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন মহাজাগতিক প্রত্যেকটি বিষয় পরস্পরের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক সূত্রে আবদ্ধ। তাদের মধ্যে কোনও অলৌকিকত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। পর্যবেক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা আসল সত্যকে উদ্ঘাটন করাই হল বৈজ্ঞানিক অভিচেতনার প্রধান উদ্দেশ্য। সুতরাং বিজ্ঞান-মনস্কতা মানুষের সভ্যতার অজ্ঞতার অন্ধকার দূরীভূত করে। এতদিন পর্যন্ত আমরা যে সমস্ত ভ্রান্ত ধারণার পথিক হয়েছিলাম সেই ধারণাগুলিকেও নিমজ্জিত করে এবং যে কোনও প্রথা প্রকরণের অসত্য উদ্ঘাটন করে। বিজ্ঞান-মনস্কতা মানুষকে সুসংযত চিন্তা শক্তি দান করে এবং তার
বিশ্লেষণী জাগ্রত করে। মানুষ আর প্রাচীনকালের দৈবনির্ভর সংস্কারের ওপর আত্মনিবেশ করে না। নতুন প্রভাতের নতুন আলোকে উজ্জীবিত হয়ে পৃথিবীর যে কোনও রহস্য
সমাধানের প্রতি আত্মনিয়োগ করে।

বিজ্ঞানমনস্কতার ধারাবাহিক ইতিহাস :- আদিম মানুষ যেদিন প্রথম আগুন জ্বালার কৌশল করায়ত্ত করেছিল সেদিনই তার মনের মধ্যে বিজ্ঞান-মনস্কতার শুভ সূচনা হয়েছিল। এরপর অনেকগুলি দিন অতিবাহিত হয়েছে। এক সময় ধর্মান্ধ গোঁড়া নীতিশাস্ত্র নির্ভর মানুষ সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ, খাদ্যাখাদ্য নির্ণয়, ধর্ম-রাজনীতি, শিক্ষা সমস্ত বিষয়ে ভ্রান্ত কুসংস্কারচ্ছন্ন অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হয়েছিল। তার পরবর্তীকালে দেখা গেল, মানুষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া কোনও বিষয়কে চিরসত্য বা অভ্রান্ত বলে গ্রহণ করছে না। তার মধ্যে ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক অভিচেতনার জন্ম হল। বিজ্ঞান চেতনার প্রসার ঘটল।
জগৎ সম্পর্কে নিত্য-নতুন ব্যাখ্যা দেওয়া শুরু হল। জীবনের উদ্দেশ এবং বিশ্লেষণ কেমন হতে পারে, সে সম্পর্কেও মানুষ নতুন করে ভাবনা-চিন্তা করা শুরু করল। এমনকি মানুষের সামাজিক অধিকার কেমন হওয়া উচিত, শোষণের বিরুদ্ধে
কী ধরনের রাজনৈতিক সংগ্রাম করা উচিত, সমাজে নারী জাতির স্থান কিভাবে আনা যেতে পারে ইত্যাদি বিষয়ে চিন্তা এবং কল্পনা করার ক্ষেত্রে মানুষ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিসম্পন্ন
হয়ে উঠল।
বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি এলেন নৃতাত্ত্বিক, সমাজবিজ্ঞানী, চিকিৎসাবিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা। তাঁদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে মানুষের মনের মধ্যে একধরনের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হয় মানুষের জ্ঞানের সীমানা নক্ষত্রলোকে প্রসারিত হয়।
ডারউইনের বিবর্তনবাদ এবং কাল মার্কসের বস্তুবাদ মানুষের বিজ্ঞান চেতনার ক্ষেত্রে দুটি দিক চিহ্ন স্বরূপ দাঁড়িয়ে আছে।

ডারউইন এই বিবর্তনবাদ:;  চার্লস ডারউইন নামে এক বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী প্রথম দৃপ্তকণ্ঠে বলেছিলেন যে এই পৃথিবীতে সর্বোত্তম শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকে। এই ঘটনাটিকে সারভাইভ্যাল অফ দ্য ফিটেস্ট অভিহিত করা হয়েছে। এই ঘটনার ওপর তিনি তার বিবর্তনের তত্ত্ব নামে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত স্থাপন করেছিলেন। ডারউইনই প্রথম বলেছিলেন যে বানর জাতীয় ডারউইনের বিবর্তনবাদ প্রাণী থেকে আজকের মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে। এক সময়ে, এই জাতীয় কথা বলার জন্যে তাঁকে নানাভাবে সামাজিক বয়কটের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। এমনকি তথাকথিত শিক্ষিত ব্যক্তিরাও ডারউইনকে নির্যাতিত করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু আজ আমরা সুপ্রজনন বিদ্যার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে জানতে পেরেছি,
ডারউইন যা বলে গেছেন তার মধ্যে এতটুকু অতিশয়োক্তি বা অসত্য নেই। সত্যি সত্যি বিবর্তনের ধাপে ধাপে বানর জাতীয় প্রাণী থেকে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে।

কাল মার্কস এর বস্তুমূলক দ্বন্দ্ববাদ- যদিও কার্ল মার্কস ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন একজন সমাজবিজ্ঞানী, কিন্তু তার Dialectic Materialism বা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বৈজ্ঞানিক অভিচিন্তার জগৎকে বিশেষভাবে
আলোড়িত করেছে। যে কোনও জিনিসের অন্তরালে ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুটি দিক আছে। এই প্রাথমিক বোধ থেকেই ঐ দ্বন্দ্ববাদের উদ্ভব হয়েছে। এভাবেই কার্ল মার্কস প্রমাণ করেছেন, কোনও কিছুকেই আমরা অভিন্ন ও অভ্রান্ত হিসাবে গ্রহণ করব না। যেখানে রহস্যের সামান্যতম আভাস আছে, সেখানে আমাদের বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি মেলে ধরতে হবে। তা না হলে কখনোই আমরা সর্বজনস্বীকৃত এবং বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারব না। কার্ল মার্কস পরোক্ষভাবে পৃথিবীর সমস্ত বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারাকে বিশ্লিষ্ট এবং পরিশোধিত করেছেন।
তাই তাঁকে আমরা মানুষের বিজ্ঞান অভিচেতনার অন্যতম দিক নির্দেশক মহাপ্রতিভাবান পুরুষ হিসাবে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে পারি।

বিজ্ঞান মানসিকতার উন্মেষ এবং বিকাশ;- পৃথিবীর নানা দেশে এখন মানুষকে বিজ্ঞানমুখী করে তোলা হচ্ছে। উন্নত দেশগুলি এব্যাপারে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। সেইদেশের অধিকাংশ মানুষ সাক্ষর হওয়াতে এবং আর্থিক সচ্ছলতা থাকাতে মানুষ সহজে বিজ্ঞান মানসিকতাকে আঁকড়ে ধরতে পারছে। সমস্যা দেখা দিয়েছে ভারতের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশকে নিয়ে।
এখানে অনেক মানুষ এখনো অবৈজ্ঞানিক অবিশ্বাসের মধ্যে দিন কাটাতে ভালোবাসেন। ব্যক্তিগত সুখ-সুবিধা চরিতার্থ করার জন্যে
তথাকথিত সমাজপতি এবং রাজনৈতিক গুরুরাও এইসব মানুষকে অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার
মধ্যে আবদ্ধ রাখতে ভালোবাসেন। কেননা, যদি একবার মানুষের মনের মধ্যে বিজ্ঞান মানসিকতার জন্ম হয় তাহলে মানুষ সমাজের অন্ধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
এবং যেখানে যত অন্যায় অবিশ্বাস আছে তার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করবে। সমাজপতিরা কখনোই তা হতে দেবেন না।
কিন্তু বিভিন্ন প্রগতিশীল সরকার নানাভাবে জনগণের মধ্যে বৈজ্ঞানিক মানসিকতার উন্নয়নের চেষ্টা করছেন। ভারতেও তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। এখানে মানব উন্নয়ক মন্ত্রক স্থাপিত হয়েছে এই মন্ত্রকের অধীনে একটির পর একটি বিজ্ঞান শিবির অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিজ্ঞানের জন্যে পদযাত্রা, স্লাইড সহযোগে বিজ্ঞান প্রদর্শনী ইত্যাদির মাধ্যমে বিজ্ঞান চেতনাকে একটি সর্বজনীন গণ আন্দোলনে রূপান্তরের চেষ্টা করা হচ্ছে।
বৃহত্তর বিজ্ঞান আন্দোলনের উদ্দেশ্যে ভারত জনবিজ্ঞান জাঠা গঠিত হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ২৬টি জনবিজ্ঞান সংস্থার উদ্যোগে পাঁচটি আঞ্চলিক শাখা খোলা হয়েছে। এই সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবকেরা গ্রামে গ্রামান্তরে পরিভ্রমণ করছেন। তাঁরা স্লাইড সহযোগে বিভিন্ন আলোচনার মাধ্যমে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করছেন। এই ভাবেই তাঁরা যুগপ্রাচীন অন্ধ প্রথার বিরুদ্ধে কুঠারাঘাত করছেন এবং সমাজের চারপাশে জমে থাকা কুসংস্কারের জঞ্জাল অপসারিত করছেন। এখন আমরা আগের থেকে অনেক বেশি বিজ্ঞান-মনস্ক হয়ে উঠেছি। আগে আমরা কেউ সূর্যগ্রহণের সময় বাইরে বেরোতাম না। কিন্তু সাম্প্রতিক সূর্যগ্রহণে বিশেষভাবে নির্মিত ফিল্টারের সাহায্যে আমরা সেই দৃশ্য অবলোকন করেছি। সম্প্রতি সূর্যের গায়ে বুধের যে ছায়া পড়েছিল, তা দেখার জন্যে হাজার হাজার উৎসাহী মানুষ বিড়লা প্লানেটোরিয়াম এবং

অন্যান্য জ্যোর্তিবিজ্ঞান কেন্দ্রে ভিড় জমিয়ে ছিলেন। এইসব ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে মানুষ বৈজ্ঞানিক অভিচেতনাকে আরো ব্যাপক এবং বৃহত্তর করে তুলেছে। আগামী
দিনে হয়তো আমরা সকলকেই বিজ্ঞান-মনস্ক করে তুলতে পারব।

উপসংহার : বিজ্ঞান-মনস্কতার অভাব জীবনকে পশ্চাদ্বর্তী করে তোলে। যারা বিজ্ঞানবিমুখ
তাঁরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকেন। বিশ্বপ্রকৃতির রহস্য তাঁরা উপলব্ধি করতে
পারেন না। যুক্তিদ্রোহী জীবন আলোক শূন্য ঘন অন্ধকার অমানিশার মতো। একমাত্র
বিজ্ঞানই কূপমণ্ডুকতাকে বের করতে পারে। গণ্ডিবদ্ধ সভ্যতা রচনার উৎকট গোঁড়ামি ভেঙে দিয়ে বিশ্বজনীন আদর্শকে স্থাপন করতে পারে। বিজ্ঞানলব্ধ জ্ঞান নিয়ে একদিন আমরা সমস্ত জীবন এবং জগৎকে নির্বিকল্প দৃষ্টিতে অবলোকন করতে পারব। এবং সেটি হবে আমাদের বিজ্ঞান চেতনা বা বিজ্ঞান মনস্কতার সার্থক বিজয়।