একটি নদীর আত্মকথা || রচনা / AKTI NADIR ANTAKATHA || RACHANA -
![]() |
আত্মকথা বিষয়ক রচনা
একটি নদীর আত্মকথা
ভূমিকা: আমি একটি নদী। আজ আমি তোমাদের আমার আত্মকথা সম্পর্কে জানাবো। তোমরা হয়তো অনেকেই জানো, মানব সভ্যতা আমার মতো কোন নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল। সুমেরীয় সভ্যতা হোক বা মেসোপটেমিয়া সভ্যতা হোক বা সিন্ধু সভ্যতা । এই সভ্যতাগুলির সঙ্গে তোমরা খুব পরিচিত। কারণ এই সভ্যতাগুলির নাম তোমাদের ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। নদী না থাকলে তোমাদের সভ্যতা গড়ে উঠতে পারত না।
পরিচিতি::- আমার নাম তিস্তা। আমি আপন বেগে আপন খেয়ালে কুলু কুলু শব্দে বয়ে চলি। তোমরা মানুষরা আমার উৎপত্তি স্থলের নাম দিয়েছো উৎস। আর সাগরে যেখানে আমি মিশে যাই সেখানের নাম দিয়েছো মোহনা। আমার ওপর অন্য কোন নদী এসে পড়লে তার নাম দাও উপনদী। আর আমি যখন দুটো শাখায় ভাগ হয়ে যাই তখন নাম দাও শাখা নদী। আবার তোমরা আমাদের কখনো কখনো দুঃখের নদী, পীত নদী, ত্রাসের নদী নামে পরিচিত করে তোলো।
স্মৃতিকথা:- আমি মোহনায় এসে পিছনের পথটা কোনদিন ভুলতে পারি না। কারণ, কোন পর্বতে গা থেকে বের হয়ে উচ্চ গতিতে জলধারা বয়ে নিয়ে সমতলে যখন প্রবেশ করি তখন আমার একটু ক্লান্তি অনুভব হয়।। সমতলে এসে নিজেকে গর্ববোধ করি। তোমাদের সঙ্গে আমার নিজের যোগাযোগ গড়ে ওঠে। তোমরা মানুষরা আমার চারিদিকে অনেক কলকারখানা সৃষ্টি করো। বন্দর সৃষ্টি করো। আমার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। সে কথা কোনদিন ভুলতে পারিনা । আমি যখন কোন গহন অরণ্যের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হই তখন আমার ভালো লাগেনা। মনে হয় আমি একা। তোমাদের ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ থেকে যাই। আবার যখন আমি মরুভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত হই তখন তপ্ত বালি এসে আমাকে গ্রাস করে ফেলে । তখন আমি খুব কষ্ট পাই। আর যখন সমতলে প্রবেশ করি তখন তোমরা মানুষরা কত আনন্দ পাও সে কথা আমার অজানা নয়। তোমরা আমার দুই তীরে গড়ে তোলো সবুজ শস্যক্ষেত, শহর, নগর, গ্রাম । আলোয় ঝলমল করে আমার চারিদিক। আমি আমি আনন্দে কুলুকুলু শব্দে বয়ে চলি।
নামকরণ:- আমার যখন নামকরণ হয় তখন আমি খুব ছোট্ট ছিলাম। সরু হয়ে অল্প জলধারা নিয়ে আমি বয়ে যেতাম । পথে চলতে চলতে কোন এক স্থানে একদল মানুষ বলাবলি করতে লাগলো," দেখো তিস্তার জল কত সুন্দর"। তখন আমি বুঝলাম আমার নাম তিস্তা। আমি গর্বিত বোধ করলাম তোমাদের দেওয়া নাম পেয়ে। আজও তোমরা ভূগোলের পাতায় আমার নাম লিখে রেখেছো। ছোটদেরকে পড়াশোনা করাও যাতে আমার কথা তারা ভুলে না যায়। এর জন্য আমি অনেক গর্বিত।। আজ আমি অনেক বড় হয়েছি। আমার জলধারা অনেক বেশি হয়েছে। অনেক চওড়া হয়েছি। আমার গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ভবিষ্যতে হয়তো আরো বড় হবো। অনেক চওড়া হবো। অনেক হয়তো জলধারা আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে।
জন্ম ও প্রবাহ : হিমালয়ের এক পার্বত্য অঞ্চলে আমার জন্ম। সেখান থেকে পর্বতের ঢাল বেয়ে প্রবল বেগে বয়ে চলি। আমার স্রোতের সঙ্গে নুড়ি
পাথর বয়ে নিয়ে পর্বত ক্ষয় করতে করতে এগিয়ে চলি। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে শেষে সমতল ভূমিতে এসে পড়ি। তখন আমার গতি কিছুটা কমে যায়। যখন মোহনার কাছাকাছি আসি তখন আমি পথ হারিয়ে ফেলে এঁকেবেঁকে বয়ে চলি। তখন আমার দুই ধারে গড়ে ওঠে ব দ্বীপ। আবার তখন অনেক পলি সঞ্চয় করে ফেলি। পলি সঞ্চয়ে ফলে আমার বুকে জেগে ওঠে চরাভূমি। তারপর ক্লান্ত হয়ে মোহনায় এসে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করি। আমি নিজেকে সাগরের সঙ্গে মিলিয়ে দিই । এখানেই আমার জীবনের শেষ।
অবদান:- তোমরা মানুষরা আমার অবদান ভুলতে পারবে না। কারণ, তোমরা যে সভ্যতার গল্প করো , সেই সভ্যতার সৃষ্টির মূলে আমাদেরই কোন পূর্বপুরুষ ছিল । তোমরা মানুষরা নদীর তীরে প্রথম সভ্যতা গড়ে তুলে ছিলে। তোমরা মরুভূমিকে নদীর সাহায্য নিয়ে করে তুলেছে, সুজলা-সুফলা। আজ আমার প্রবাহ পথে আমার জলের দ্বারা তোমরা আমার আশপাশের কৃষিজমিকে করেছ সুজলা সুফলা। নানা ফসল ফলাছো। সবজি চাষ করছো। আবার কোথাও কোথাও আমার বুকে জাহাজ স্টিমার নৌকা চালিয়ে মালপত্র বয়ে নিয়ে যাচ্ছো। আবার কোথাও কোথাও আমার গর্ভ থেকে বালি তুলে নিজেদের ঘরবাড়ি তৈরি করছ। আমার বুকে, জলে বসবাসকারী মাছেদের ধরে তোমরা ব্যবসা-বাণিজ্য করছ। এরপরেও কি তোমরা আমার অবদান অস্বীকার করতে পারবে? পারবে না। তোমরা মানুষরা আমার জলে স্নান করে নিজেকে পবিত্র করছ। আমার জল নিয়ে ঈশ্বরের সেবা করছো। আবার আমার জলে ঈশ্বরকে বিসর্জন করছো। আবার আমার জলের গতিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নিজেদের বাড়িঘর আলোকিত করছ। এগুলি কি আমার অবদান নয়?
উত্থান-পতন ;- মানুষের জীবনে যেমন উত্থান-পতন, ভাঙ্গা-গড়া আছে। তেমনি আমার চলার পথে আছে উত্থান-পতন, ভাঙ্গা গড়ার খেলা। আমি একদিকে যেমন তোমাদেরকে জল দান করে সমৃদ্ধ গ্রাম শহর ও কৃষিক্ষেত্র গড়ে তুলি। অন্যদিকে তেমনি সমৃদ্ধ গ্রাম নগর আমার স্রোতের আঘাত সহ্য করতে না পেরে আমার বুকে তলিয়ে যায়। আবার বন্যায় যেমন আমার দু পাড়ের সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাই, তেমনি দু পাড়ের জমিতে পলি সঞ্চয়ের দাঁড়া উর্বর করে তুলি।
সম্পর্কের বন্ধন;- তোমরা মানুষরা আমাকে ভালোবাসার বাঁধনে বেঁধে, আমার তীরে গড়ে তুলেছ বিভিন্ন মন্দির, সমাধি , বিভিন্ন পীঠস্থান এবং শ্মশান। তোমরা মানুষরা আমার বুকে তোমাদের জীবনের শেষকৃত্য করে তোমরা তৃপ্তি পাও। আমিও তোমাকে সহযোগিতা করি। কেউ কেউ যখন তোমরা আমাকে মা বলে ডাকো । আমি তখন আরো গর্বিত হই। কখনো কখনো তোমরা তোমাদের দেব-দেবী নামের সঙ্গে আমাকে সম্পর্ক স্থাপন করে ফেলো। তখন আমার আনন্দে দুচোখ ভরে জল আসে। ছটপুজোয় তোমরা আমার নদীর তীরে এসে প্রদীপ জ্বালিয়ে শুভ কামনা করো। আমি দুচোখ ভরে দেখি। কিন্তু আমি তোমাদের কোন আশীর্বাদ করতে পারি না। আবার কখনো কখনো কোনো নৌকাডুবি হলে তোমরা আমার গর্ভে তলিয়ে যাও। তখন আমার মনে খুব কষ্ট হয়। তখনও কিছু করতে পারি না। কারন আমি তো শুধুমাত্র একটা নদী। শুধু বয়ে চলাই আমার কাজ।
উপসংহার : তোমরা মানুষরা অনেক স্বার্থপর হয়ে উঠছো। দিনদিন তোমরা আমার বুকে বাঁধের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছো। বাঁধ দিয়ে আমার গতি কমিয়ে দিচ্ছে। প্রতিনিয়ত কলকারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ এবং শহরের নর্দমার নোংরা জল আমার বুকে ফেলে আমাকে ক্রমশ দূষিত করে তুলছ। কখনো কখনো আমার গতিপথ কে পরিবর্তন করছ আমার গর্ভ থেকে অতিরিক্ত পরিমাণ বালি তুলে আমার গতিকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করছো। কিন্তু এর ফল তোমাদের মত মানুষকেই ভোগ করতে হবে। আমার গতি প্রতিযোগী বাধা ঘটে, তোমরাও হয়তো অনেক ক্ষয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে তখন আমাকে দোষ দেবে না কারণ এর জন্যই তোমরা দায়ী থাকবে। আর আমার এই দূষিত জল খেয়ে যদি তোমাদের কিছু খারাপ ঘটনা ঘটে তার জন্য আমাকে দোষী করতে পারবে না। কারণ এর জন্য তোমরা দায়ী থাকবে। আমাকে যতটুকু পরিষ্কার রাখবে তোমরা ভালো থাকবে। আর আমি তোমাদের দুহাত ভরে আশীর্বাদ করব।